অপদার্থ হতভাগা
meherhossain1752@gmail.com
আমার পৈতিৃক ভিটা এটা। নিজের কেউ থাকে না এখন। আমার মত জীবিকার তাড়নায় ভাই
বোনদের সবাই বাইরে।
সরকারী চাকরি। সাধারনত ঈদের ছুটিতেই বাড়ীতে আসি। অতদিন পর এসে তালাবন্দ ঘরদোর
ঝাড়া মোছা করে ঠিকঠাক করতে করতেই দিনগুলো ফুরিয়ে যায়। এখানে নিজেকে আপন করে
কাছে পাওয়া যায়। তায়তো ছুটে আসি।
এ ধরনের ছুটির সময় গ্রামের চেহারাই যেন পালটে যায়। খেটে খাওয়া মানুষগুলো কাজ ফেলে দূরদূরান্ত থেকে আসা আপনজনদের আদর আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সেই ফাকে তাদের কাছ থেকে অনেক মুল্যবান উপদেশ, আদেশ নিষেধ শোনার এবং তাদের নিজেদের জীবনের মিছেগুলোও ভালভাবে নতুন করে বোঝার সুযোগ লাভ করে।
তারপর শুরু হয় মোহ ভঙ্গের যজ্ঞ। ছুটিতে আসা গুরুত্বপূর্ণ কাজের মানুষ গুলো কাজে ফিরে
যাওয়ার তাড়নায় মেতে ওঠে। খেটে খাওয়া মানুষ গুলোও সোনার হরিনের মত পাওয়া
অতিথিদেরকে হারানোর ব্যথায় মোচড় খাওয়া বুকে আবারও আশায় বুক বেধে ক্ষেত খামারের
কাজে লেগে যায়।
এটায় গ্রাম বাংলার পরিচিত চেহারা এর মধ্যে নতুনত্য কিছুই নেই।
কিন্তু এবার আমার বেলায় ঘটলো কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ আমার ছুটিটা মিললো ঈদের সময় না,
ঈদের পর। মানে সবাই যখন ঘর থেকে ফিরছে তখন আমার ঘরে আসার পালা। যাকে বলে
আশা ভঙ্গ।
এ সময়টায় মনে হলো সবকিছু যেন অসহনীয় কবরের নিস্তব্ধতার মত।
অনেকদিন বন্দ থাকা ঘরটার গুমোট গদ্ধের মধ্যেই কোন রকমে রাত্রিটা কাটিয়েছি। বাংলো
প্যাটানের বেশ উঁচু বারান্দা ঘেরা বাড়ীটার প্রশস্ত ছাদের ঠিক মাঝখানে দোতলা একটা ঘর। ছুটিতে আসলে এ ঘরটাতেই উঠি। সকাল থেকে ঝাড়া মোছার কাজটা শুরু করেছি। কিন্তু এবারে কেন জানি সব কিছুই কেমন উল্টো পাল্টা লাগছে।
সকাল প্রায় আটটা বাজলো কিন্তু একটা কেউ খোজ নিতে আসলো না। হটাৎ করেই কি কোন
বৈপ্লবিক পট পরিবর্তন হলো!
একবার মনে হলো আমার আসার ব্যাপারে কেউ হয়তো জানে না। আবার মনে হলো নাহ্ তা কি করে হয়। আবার ভাবলাম ঈদের পরে সবাই নিশ্চয় কাজে ব্যস্ত। তবুও কোন এক অজানা অতৃপ্তি
মনে লেপটে থাকলো।
কাজ ছেড়ে দোতলা ঘরের পেছনের জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালাম। সামনে ছোট্ট একটু ফাঁকা
জায়গা কিন্তু এই মুহুর্তে মনে হলো যেন সীমাহীন শুণ্যতা।
হটাৎ করে মনে হলো অপদার্থ মোড়লের কথা। ভিষণ রাগ হলো ওর ওপর ।
মোড়ল আমাদের বাড়ীর অনেক পুরোনো কাজের মানুষ। বাড়ীটা ওই দেখেশুনে রাখে। নিজেকে
কিছুতেই বুঝাতে পারলাম না যে অন্য সবার কিছু না কিছু কাজ থাকতেই পারে কিন্তু– ঐ অপদার্থ
হতভাগাতো আমার আসা উপলক্ষে একটা কাজ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করে এতোক্ষনে ছুটে
আসার কথা।
আমার মত ব্যস্ত একজন মানুষের মোড়লের মত তুচ্ছাতিতুচ্ছ একটি চরিত্রের কথা মনে হওয়ার
কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। কিন্তু এই মূহুর্তে ওর অনুপস্থিতি ওকে আমার কাছে দারুন ভাবে
মূল্যবান করে তুললো।
মোড়লকে আমি বরাবরই অপদার্থ হতভাগা বলি এবং এটা অর্থ করেই বলি। সৃষ্টিকর্তার উপর কিছুটা রাগ বা উপহাস করেই বলি।
মোড়লের তার নিজের সৃতি স্পষ্ট হয়ে মনে আছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। যুদ্ধের বেশ আগ থেকেই ও আমাদের বাড়ীতে। গ্রামের একজন হয়েই ও থাকে এখানে।
মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ীতে কাজ না থাকলে মোড়ল গ্রামের অনন্যদের কাজ ও করে। আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে এ ব্যাপারে। কারণ জিগ্যেস করলে ও বলেছিল –কাজ না থাকলে ওর ভাল লাগে না। কাজ করে দেই তবে টাকা নেয় না।
ওর কথা অনুযায়ী ও গ্রামের প্রায় সব লোকের কাছেই কিছু না কিছু পাওনাদার। যাদের বাড়ীতে দিন মজুরী করেছে সেই গৃহকর্তা ওকে মজুরী দেয়নি কারন মোড়ল মজুরী চায়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে ওর বিশেষ কোন অভিযোগ নেই বরং অদ্ভুত রকমের দয়া দেখানোর একটা মানষিতা ওর মধ্যে কাজ করে।
-আর না, এইবার আমার পাওনা সব টাকা কড়ি পায় পায় করে আদায় করবো। কোন কারণে
কারো উপর রাগ হলে তখনই কেবল ওর পাওনার কথাগুলো বলে মোড়ল।
হায়রে, জীবন যাকে একটুও দয়া দেখাইনি তার মনে এত দয়া!
হতভাগা ওর বাবা মার খোজ জানে না। জন্মের আগেই নাকি ওর বাবা নিজ কর্তব্য শেষে বিদায়
নিয়েছে। আর বেচারি মা কোন রকম কর্তব্য সম্পাদন করেই পটল তুলেছে। তায় কারো কথা ওর
মনেও নেই আর ওদের প্রতি কোন দায় দায়িত্বের তাড়নাও ওর নেই।
এ সমস্ত কথা বিভিন্ন সময় ছুটিতে এলে অবসর কাটানোর উপায় হিসাবে ওর বকবকানি থেকে
শোনা।
ওর জীবনটা বইয়ের কাহিনীর মত। যা কেবল অসম্ভব বড় দরের মানুষের ক্ষেত্রে মানায়। কিন্তু ঐ
হতভাগা এ কাহিনী কোথায় পেল তা কখনো আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। মনে হলো আজকে হাতে
অনেক সময়, হতভাগাকে পাওয়া গেলে জিজ্ঞেস করবো।
ওর গায়ের রংটা এখানকার অন্যান্য সবার মত হলেও চোখে নাকে বোঝা যায় ও এখানকার কেউ
না, অন্যখানের মানুষ।
আসামের কোন এক খানে বাড়ী বলে ও বলে। ভালো করে জানে না কিছুই নিজের সম্পর্কে। আর
তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথাও নেই ওর। ছোট বয়সে কি ভাবে যেন এসেছিল এ অঞ্চলে। তারপর
দিনে দিনে অনেকদিন হয়ে গেল।
এ তল্লাটে নেই কেউ ওর।
ও যখন আনমনে বসে থাকে তখন ওকে বড্ড একাকী লাগে।
আসছে না দেখে ওর উপর রাগটা বাড়তেই লাগলো।
ও আমাকে খোকা বলে ডাকে। কিন্তু ওর গলার ভিতরকার ছোট জিহ্বাটা একটু ত্রুটিযুক্ত থাকায়
অনেক গুলো বিকৃত উচ্চারনের মধ্যে ওর সব ক এর উচ্চারণ ড় হয়ে আমাকে খোকা বলে ডাকলে তা খোড়া বলেই শুনাই। এতে করে বরং ওকে নিয়ে মজা করার আর একটা উপকরণ পাওয়া যায়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হলো অন্যান্য সবার মত আব্বাও সবাইকে নিয়ে বাড়ী ঘর ফেলে দূর গ্রামে
আশ্রয় নিলেন। আমাদের গ্রামটা বলতে গেলে একদম ক্যাণ্টনমেণ্টের সাথে লাগানো তায় সবাই
ভয়টা একটু বেশীই পেয়েছিল।
অদ্ভুত মোড়ল অদ্ভুত কান্ডটাই করলো। সবাই যখন জান মাল নিয়ে একজনের আগে অন্যজন পালাতে
ব্যস্ত মোড়ল তখন আব্বাকে অভয় দিয়ে বললো -তোমরা যাও আমি বাড়ী পাহারা দেব।
সে কারো কথা গুনলো না, বাড়ী পাহারা দেয়ার জন্য থেকে গেল মোড়ল।
যুদ্ধ শেষে বাড়ী ফিরে সবাই দেখলো কংকাল সদৃশ্য মোড়ল আর আগুনে পুড়ে বৃষ্টিতে ধসে পড়া ছাওনি বিহীন উঁচু উঁচু ঘরের ভিত।
সবাইকে দেখে মোড়ল দাড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু হায়িয়ে ফেলে শুন্য ভিটার উপর ধপ করে বসে পড়ল আর ওর হাড়ের কাঠামোর মত দুই হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুজে বুক ফাটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
-আমার সব শেষ হয়ে গেছে রে! ওরা কিছু বাকি রাখলো না, এত করে বললাম কিন্তু শুনলো না,
আমার ধরে মারলো তারপর বেধে রেখে চোখের সামনে সব ছাই করে দিল।
ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে মোড়ল ওর দেহের ক্ষতস্থান গুলো দেখাতে লাগলো।
বেশ বেলা হলো কিন্তু এখনও কারো দেখা নেই।
মোড়লের উপর রাগ আর অভিমান ক্রমেই বাড়তে লাগলো । মনে মনে ঠিক করলাম ও আসলে
প্রথমে কথাই বলবো না।
আব্বা মারা গিয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। তিনি বেচে থাকতে একটা অভিযোগের মুখোমুখি
সবসময় আমাকে হতে হতো- কেন চিঠি লিখি না। একটু বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকলে তিনি
আহত কণ্ঠে বলতেন- এখন বুঝবিনে খোকা, আমি মরে গেলে যখন বলার কেউ থাকবে না
তখন বুঝবি। খুব হাসির হলেও আর্শ্চয্যের ব্যাপার হচ্ছে যে, আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে
মোড়লও ঐ একই কথা অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বলে- খোড়া আমি মরে গিলি তখন বুঝবি।
কবে কোথা থেকে ও এ অঞ্চলে এসেছিল তার খোজ কখনও নিইনি। তবে শুনেছি একবার কোন
একজন লোক এসে নাকি ওকে ভাই বলে দাবি করে খুব কান্নাকাটি করেছিল। কিন্তু মোড়লের
মধ্যে কোন ভাবাবেগের উদ্রেগ হয়নি বরং ও বিরক্তি প্রকাশ করে এই বলে সন্দেহ প্রকাশ করে যে-
লোকটা ওর কাছ থেকে সম্পত্তির ভাগ নিতে এসেছে।
-স্যার নাস্তা করবেন না।
আমার সাথে আসা কাজের ছেলেটার হটাৎ ডাকে চমকে উঠে তাকালাম ওর দিকে।
টেবিলে নাস্তা লাগাতে বলে হাটতে হাটতে বাড়ীর সম্মখুস্ত পুকুরের উচু পাড়টার উপর গিয়ে
দাড়ালাম।
কোথাও কেউ নেই, চারিদিক ফাঁকা। একটা ধোঁড়া সাপ পাড়ে উঠে রোদে গা শুকাচ্ছে। আমাকে
দেখেও যেন অগ্রাহ্য করলো। এক কোনায় এক পায়ে দাড়িয়ে একটা সাদা বক ঝিমোচ্ছে।
কিছুই ভালো লাগছে না। ইচ্ছা হলো একটু পারিবারিক গোরস্থান থেকে ঘুরে আসি।
দেয়াল ঘেরা গোরস্থানের ভিতরটা আগাছায় ভরে গেছে।
গোরস্থান পরিস্কার রাখার ব্যপারে মোড়ল চিরকালই খুব আন্তরিক ছিল।
-এখেনেই ঘুমতি হবে সবার।
আমরা যখন ছোট তখন সবাইকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গোরস্থান পরিস্কার করার কাজে
নিয়ে যেত মোড়ল।
মনটা বিরত্তিতে ভরে উঠলো। হটাৎ করে মনে হলো কে যেন বলছে-খোড়া আমি মরে গেলে বুঝবি।
মনের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। মোড়লের জন্য বুকের মধ্যে ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। কি
হয়েছে ওর! কোন অসুখ, কঠিন কোন কিছু! খুব আফসোছ হতে লাগলো। নিজের উপর কিছুটা ক্ষোভের
সৃষ্টি হলো।
হন্ত দন্ত হয়ে বাড়ীর দিকে পা বাড়ালাম। চাচার সাথে দেখা।
দুএকটা কথাবার্ত্তার পর আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম-মোড়ল কি মারা গিয়েছে! সংক্ষিপ্ত জবাব –
হ্যেঁ, কয়েক মাস হলো।
ভাবাবেগহীন ছোট্ট জবাব, কিন্তু ধারালো ফলার মত যেন বুকে বিধলো।
ঘরে ফিরে এলাম। কতক্ষন নিস্তব্দ ভাবে পায়চারি করলাম।
অল্প সামান্য জিনিষপত্র যা বের করেছিলাম সেগুলো সুটকেছে ভরলাম। এখানে আর এক মুহুর্তও
থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে যাবে এখনি।
কাজের ছেলেকে সুটকেসটা নামাতে বললাম। ও তাকাল আমার দিকে। ভেজা চোক দুটো ওর নজরে পড়লো কিনা বুজলাম না। মাথা নিচু করে চলে গেল।
ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে নামলাম। একুশটা সিড়ি। খুব অবসন্ন লাগলো।
হটাত করে বৃষ্টি নামলো। ফিস ফিসে বৃষ্টি। যেন বোবা কান্না। আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম গাড়িতে উঠবো বলে।
চাচা আসলেন।
-তোমার সাথে কোন কথায় হলো না বাবা, বোঝতো ঈদের ছুটির পর সবাই—। আমাকে সময় না দিতে পারার অজুহাত।
মোড়লের কবরটা অজান্তেই জিয়ারত করে ফেলেছি ভেবে মনটা একটু হালকা লাগলো।
আমি চাচার হাত ধরে করমর্দন করলাম।
গাড়ীতে উঠার পূর্ব মুহূর্তে অনেকটা স্বগত ভাবেই চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম-মোড়লের কবরটা
কার পাশে।
-সরকারী ডোবা, কত বেওয়ারিস লাশের দাফন, ঠিক রাখার উপায় নেই। তিনিও তেমনি ভাবেই জবাব দিলেন।
অবাক হয়ে তাকালাম চাচার মুখের দিকে। মোড়লের মৃত দেহটার জায়গা হয়নি আমাদের
পারিবারিক গোরস্থানে!
বৃষ্টির ফোটার সাথে ততোক্ষণে ভেজা চোক দুটো একাকার হয়ে গেছে।
কাজের ছেলেটাকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে গাড়ীতে উঠিয়ে গাড়ী ষ্টার্ট দিলাম।
চাচার গলার স্বর ভেষে আসলো- এই ভর সন্ধ্যাই কোথাই যাচ্ছ বাবা এর পর একটু খবর দিয়ে এসো।
-‘বেওয়ারিস লাশের দাফন’ আর মোড়লের সেই কথা- ‘খোড়া আমি মরে গিলি বুঝবি’। কথাগুলো বার বার কানে বাজতে লাগলো।
রাত হয়ে এলো, সঠিকই এখন কোথায় যাব জানি না। তবে এটা বুঝতে পারছি যে পালিয়ে যাচ্ছি আমি।
মোড়লের ঐ তুচ্ছ কথার অর্থ কখনও বুঝিনি এবং বোঝার প্রয়োজনও মনে করিনি। কিন্তু এই মূহুর্তে
মনে হচ্ছে কথাগুলো অর্থহীন নয় এবং মোড়ল অপদার্থ হতভাগা নয়।
Category: Bangla, Short Story