মেরু মিঞা
বয়সের অর্ধেকেরও বেশী সময় ধরে চাকরী করছি।
চাকরীর বয়সটা দেখতে দেখতে অনেক হলো। হিসেব করতে বসলে অবাক হয়ে যায়। মিলাতে
পারি না।
জীবনের বেশীর ভাগ সময়টা চাকরী করতে করতে চাকরই হয়ে গিয়েছি। তানা হলে আদেশ
পালন করতে এ বৃদ্ধ বয়েসে এই পাহাড় জঙ্গলে এভাবে একাকী কেউ পড়ে থাকে।
বারো ভাই বোনের বড় সংসারের এক নগন্য সদস্য আমি। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার হলেও
ভাগাভাগির দৌরাত্বে সব কিছুতেই সবসময় টানাটানি। বারোটা ছেলে মেয়ের মধ্যে সন্ধ্যার
পর কে দেরী করে ফিরলো, ফুটবল খেলতে যেয়ে কারো বা পায়ে মচকা লাগলো এসব
নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে খোজ রাখার মত সময় সুযোগ বা ধৈর্য কোনটায় বাবার ছিল না।
তায় মোটামুটি আমরা সবাই মানুষ হয়েছি নিজের মত করেই।
ভাগ্য আমার ব্যাপারেই কেবল ব্যতিক্রম ঘটালো। মুলতঃ মেধার জোরেই আমার আর অন্যান্য
সবার মত হওয়া হলো না।
ডিসটিংসান সহ ম্যাট্রিক পাশ করার পর থেকেই ভাল কলেজে পড়ার জন্য বাড়ী ছাড়লাম।
তারপর সিলেকশান গ্রেডে চাকরী পেয়ে সবাইকেই ছেড়ে চলে আসলাম। আর অন্যান্যরা
অল্পে সন্তুষ্ট থেকে সংসার পেতে বাপ দাদার ভিটেতেই হেসে খেলে থেকে গেল।
মা আগেই বিদায় নিয়েছেন। বাবাও চলে গেলেন। কালে ভাদ্রে বাড়ীতে গেলে সবার মুচকি
হেসে অতিথি এসেছে মন্তব্য গুনতে শুনতে নিজ বাড়ীতে সত্যিসত্যিই অতিথি হয়ে গেলাম।
তারপর চাকরীতে চেনা পরিচয়ের সুবাদে বিয়ে করে নতুন আর পুরনোর মাঝখানে একটা শক্ত
দেয়াল খাড়া করে দিলাম।
আমার এ নতুন ভূবনে সবার সাথেই পরিচয় কাজের খাতিরে, আর কাজের খাতিরেই হৃদ্যতা।
কাজের পরিধিতে আর পরিবেশে পরিচয় সবার সাথে। নতুন ষ্টেশানে এসে পূর্বে একত্রে চাকরী
করেছি এমন কাউকে পেলে তার সাথে পুরোনো কিছু সৃতির বদৌলতে হৃদ্যতাটা অন্যান্যদের থেকে একটু বেশী। এই যা পার্থক্য।
আমার এ ভূবনের সাথে জন্মগত পরিচয় শুধু আমাদের ছেলে মেয়ে দুটোর। ওরা এ ভূবনেই
জন্মেছে তায় এ ভূবনের সাথে ওদের সম্পর্কটা নাড়ীর।
বাস্তবতার তাড়নায় বেশ কয়েক বছর ধরে ওদের কেউই আমার সাথে নেই। আছে ওদের নিজ
নিজ ভূবনে।
মেয়েটার বিয়ে হয়ে স্বামীর সাথে বিদেশে থাকে। ভালো আছে ওরা ওখানে।
বদলীর চাকরী তায় ছেলেটাকে বরাবরই রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পড়াতে হয়েছে। মাঝে মধ্যে ছুটিতে আসলেই কেবল ওকে পাওয়া যেত। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর স্কলারশিপ পেয়ে
আমেরিকাতে লেখাপড়া করছে দুবছর হয়ে গেল। কম্পিউটার সায়েন্সে নিয়ে পড়ছে। বছর
পাচেক লাগবে। তারপর সেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে নিজ ভূবনে।
বছর দেড়েক আগে মেয়েটার বাচ্চা হওয়া উপলক্ষে আমার স্ত্রী গিয়েছে ওখানে।
একটা পুত্র সন্তান হয়েছে ওদের। মায়ের জন্য আমার মেয়ে রেসিডেন্সি ভিসার ব্যবস্থা
করছে। একেতো নাতি হওয়ার আনন্দ তার উপর বিলেতে রেসিডেন্সি ভিসা আমার স্ত্রী খুশীতে গদ গদ হয়ে আমাকে টেলিফোনে সব জানালো। আরো জানালো যে ওদেরকে ছেড়ে
আসতে একদম মন চায়ছে না তায় আরো কিছুদিন থেকে আসবে।
কদিন হলো এখানে বদলী হয়ে এসেছি। বাসায় উঠবো না ঠিক করেছি। অতবড় বাসা একা
থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। তায় এখানকার সময়টুকু রেষ্ট হাউজেই কাটাবো মনোস্ত
করেছি।
আমার খাবার দাবার দেয়া বা টুকটাক সাহায্য করার জন্য রেষ্ট হাউজের একজন ওয়েটারকে
দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ও সালাম দিয়ে দাড়ালো।
ওর দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলাম।
কেন জানি ওর চেহারাটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না আমার কাছে। মুখটা শুখনো, চোয়ালের
হাড্ডি ঠেলে বের হয়ে চোয়াল দুটো ভিতরে ঢুকানো। নাকটা সরু লম্বা, চোখ দুটো গর্তের মধ্যে
মার্বেলের মত জ্বলজ্বল করছে।
কানদুটো খাড়াখাড়া। ছোট লম্বাটে মুখোমন্ডল।
ও আমার কাছেই দাড়িয়ে তবু যেন মনে হচ্ছে অনেক দূরে।
ওর শরীরটা একদম পাতলা, মনে হয় যেন একটা হাড্ডির কাঠামোর উপর প্যান্ট সার্ট পরানো।
মুখের দিকে তাকালে মনে হয় অনেক লম্বা ও। কিন্তু পুরো শরীরটা দেখলে বোঝা যায় পাঁচ ফুটের নিচে ওর উচ্চতা।
ওর মুখোমন্ডল আর দেহের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই।
ওর মুখে আরেকটু বাড়তি পুষ্টি সরবরাহ করতে পারলে ওর ওই সূচালো নাকওয়ালা মুখটা যে
কোন কারো নজর কাড়তো। আর শরীরের উচ্চতাটা আরো একটু বাড়লে সুন্দর একটা চেহারা
হতো ওর।
ওর সুন্দর মুখোমন্ডলটা যেন অন্য কোন সুঠাম আর পুষ্টি সমৃদ্ধ শরীরের জন্য তৈরী।
একেবারে মেদশুণ্য ছোটখাটো শরীরের বয়সটা অনুমান করতে গেলে দারুন রকম ভুল হবে।
পঞ্চাশ থেকে আশির মধ্যে হবে ওর বয়স।
-নাম কি তোমার?
-মেরু মিঞা।
হেসে জবাব দিল।
সরু সরু দাত বের করা হাসিতে ভারী সুন্দর আর আন্তরিক লাগলো ওকে।
ও কেন হাসলো ঠিক বুঝলাম না। নিজের ও রকম একটা নামের জন্য, নাকি আমাকে দেখে
ও যে খুশী সেটা বোঝানোর জন্য, নাকি অন্য কোন কারণ আছে তা ঠিক বোঝা গেল না। তবে
হাসি আমারও লাগলো ওর নাম শুনে।
-স্যার, সন্ধ্যার খাবার কয়টার সময় লাগাবো। কাল থেকে তো রোজা, সেহেরী খেতে কখন
ডাকবো।
বেশ কর্তব্যপরায়ন মেরু মিঞা। রোজার সময় এই কনকনে শীতের মধ্যেও শেষ রাতে আমার
খাবার আনবে। ভাবতে নিজের কাছে একটু অস্বস্তি লাগলো।
-এই শীতের মধ্যে তুমি আবার কষ্ট করে উঠবে?
আবার সেই হাসি সরু দাতগুলো বের করে।
-স্যার আমিও রেষ্ট হাউজে ঘুমোই, পাক ঘরের সাথেই একটা ঘরে। তায় বাড়তি কোন কষ্ট
না।
-কেন, তোমার পরিবার?
আবার একটু হাসলো মেরু মিয়া। একই রকম হাসি।
-ওরা কেউ আমার সাথে নেই।
অবাক হলাম ওর কথায়।
মেরু মিয়া সংক্ষেপে একটা বর্ণনা দিল ওর নিজের সম্মদ্ধে, বোধহয় আমার উৎসুকতা দেখে।
অতি দরীদ্র এক বাবা মায়ের অনেক সন্তানের একজন ও। ছোটকালে পেটের দায়ে বাবা ওকে
এই ডিপার্টমেন্টের এক অফিসারের বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে পাঠিয়েছিল। ও বড় হলে
সেই সাহেবই ওকে এই রেষ্ট হাউজে চাকরীটা দিয়েছে।
সরকারী চাকরী তায় নিজের বাড়ী থেকে অনেক দূর হওয়া সত্ত্বেও থেকে গেল এখানে। তারপর
ধীরে ধীরে বাড়ীর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। শেষে এদেশে বিয়ে করে এখানেই থেকে গেল।
ওর চারটে ছেলে আর একটা মেয়ে। বলতে গেলে ছোট কাল থেকেই ছেলেগুলোকে পরিচিত
সাহেবদের সাথে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। সাহেবরাই ওদের সবাইকেই একেকটা চাকরীও
দিয়েছে। সবাই নিজ নিজ সংসার নিয়ে দূর দুরান্তে বসবাস করছে। যোগাযোগ নেই তেমন
তবে বিভিন্ন সাহেবদের কাছ থেকে ও খবর রাখে ছেলেদের। ভালো আছে সবাই।
মেয়েটা সবার ছোট। গারমেন্টসে চাকরী করে। ওকে একটা ভালো ছেলের সাথে বিয়ে
দিয়েছে। বেকার ছেলে। মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছিলো তায় জামাইকে একটা চাকরী যোগাড় করে
দেয়ার ভরসা দিলে বেকার হয়েও ছেলেটা রাজি হয়েছিল বিয়ে করতে।
অভাবী সংসার তায় শশুর বাড়ী যেয়েও মেয়েটা গারমেন্টসের চাকরী ছাড়েনি। কিন্তু বিয়ের পর
বছর গড়াতে না গড়াতেই একটা বাচ্চা হলো মেয়েটার। সে থেকেই ওর শশুর শাশুড়ী নারাজ
মেয়েটার উপর। কারণ মেয়েটা আর গারমেন্টস কারখানায় যেতে পারে না।
এদিকে শত চেষ্টা করেও জামায়ের একটা চাকরী জোগাড় করে দিতে না পারায় মেয়ের শশুর
বাড়ী থেকে নানা রকম কথা বলতে লাগলো ওরা।
শেষে বাধ্য হয়ে ওর স্ত্রী মেয়ের সংসারে থাকে। ও বাড়ীর যাবতীয় রান্না বান্নাও করে আর
নাতিকেও রাখে। যাতে করে মেয়েটা আবার গারমেন্টস কারখানায় কাজে যোগ দিতে পেরেছে।
গত বছর দুই হলো মেরু মিয়া নিজের বাড়ী ছেড়ে দিয়ে এই রেষ্ট হাউজে থাকে।
আবারও ওই সরু দাতগুলো বের করে হাসলো ও।
-স্যার ওদিককার জানালাগুলো একরকম বন্দ করেই দিয়েছি।
আমিও হাসলাম ওর মত করে।
মনে হলো ও একটু অবাক হলো আমার হাসি দেখে।
হটাৎ করে ওর বোধহয় খেয়াল হলো খাবার আনার কথা। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল মেরু
মিঞা।
বুকের বা দিকটা কিন কিন করে ব্যথা করতে লাগলো। বেড়েই চললো ব্যথাটা। বেশ ঠান্ডা
তবুও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠলো কপালে। মনে হচ্ছে দমটা বোধহয় বন্দ হয়ে যাবে।
জানালাটা খুলে ধারে বসলাম।
খাবার নিয়ে ও আসলো একটু বাদে।
কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখলো আমার দিকে। কপালে জমে ওঠা ঘামের বিন্দুগুলো ওর কোঠরাগত
চোখদুটো দেখলো কিনা বুঝলাম না।
-এই ঠান্ডায় জানলা কেন খুলেছেন।
জানালার কপাটদুটো ঠেলে বন্দ করতে করতে বললো ও।
-বাইরের দিকের সব জানালা গুলো বন্দ রাখায় ভালো। এ সময় টুকু নিজ ঘরের মধ্যে থাকলে
ভাল, দরকার পড়লে এসির বাতাস ছাড়লেই হলো। বাইরের জানালা দিয়া আসা খোলা বাতাস
আপনার জন্য ক্ষতিকর।
একটু অবাক হলাম ওর কথাই, কী বুঝাতে চাইল ও!
তবে আমার শরীরের এ অবস্থায় ওর নিলির্প্ততা দেখে কেন জানি মনে একটু জোর পেলাম।
ও এসিটা অন করে দিতেই আমার কপালের ঘামগুলো শুখিয়ে গেল।
মেরু মিয়া খাবার গুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখলো একএক করে।
-আপনি খান স্যার আমি বাইরে দাড়ায়।
আমি তাকালাম ওর মুখের দিকে।
সেই হাসিভরা ওর মুখখানা।
-আমার স্যার এসির বাতাস একদম সহ্য হয় না। বাইরের বাতাসও এই শরীরে এখন আর কুলোয় না। আগে অসুবিধে হতো না এখন বয়স হয়েছে তো। আমি মাফলার দিয়ে কান মাথা ঢেকে নেব। আমি
নিজের মত করে আমার জন্য ব্যবস্থা করে নিয়েছি।
একই রকম হাসি ভরা মুখেই বেরিয়ে গেল ও।
ওর নাম মেরু মিঞা কে রেখেছিলো আর কেনই বা রেখেছিলো জানি না। ওর নামের অর্থ ও
নিজেও জানে কিনা তাও বলতে পারবো না সঠিক ভাবে। কিন্তু ও যে হীমশীতল মেরুর একাকী
বাসিন্দা সে কথা বোঝে মেরু মিঞা সে বিষয়ে আমার আর কোন সন্দহ রইলো না।
জীবনের এই শেষ পর্যায়ে এসে বুঝলাম ওতে আমাতে তেমন কোন তফাৎ নেই। দুজনই
হিমশীতল মেরুর বাসিন্দা আমরা।
Category: Bangla, Short Story