অন্যান্য বারের মত এবারও মেয়ের ছুটির সাথে মিলিয়ে ছুটি নিয়েছিল আরিফ। বৃদ্ধ বাবা মা আর ভাবনকে নিয়ে অনেক ঘুরতে গিয়েছিল এবার। ভাবনার পছন্দ মত ওরা গিয়েছিল সমুদ্র সৈকতে। সেই সৈকত যার গর্জনের মধ্যেই ভাবনার জন্ম।
সেই হানিমুনের পর আর আসা হয়নি এদিকে। ওর মাকে নিয়ে এখানে আসার কথা আরিফ বলেছে মেয়েকে।
সেবারেও একই রেষ্ট হাউজে উঠেছিল ওরা। সেনাবাহিনীর রেষ্ট হাউজ একদম বিচের গা ঘেসে দাড়ানো। সবগুলো রূমের সাথেই সমুদ্রের দিকে মুখ করে চওড়া বারান্দা। সেখানে বসলেই সৈকতের গন্ধ পাওয়া যায়। আরিফের বাবার এক বন্ধুর রেফারেনছে রূমটা ভাড়া নিয়েছিল।
খুব আন্তরিক মেয়ে ছিল অনন্যা। সময়টা ছিল শীতের শুরূ। চাঁদনি রাতে বিচে হাটতে হাটতে ওর নানা চঞ্চলতা। আর গভীর রাতে রেষ্ট হাউজে ফিরে জোৎস্না ধোয়া জনমানবশূণ্য সৈকতের নিস্তব্দতা আর সমুদ্রের একটানা গর্জনের সাথে গলা মিলিয়ে অনন্যার কণ্ঠে ‘আজ জোৎস্না রাতে সবায় গেছে বনে’ গানটা যে এক স্বপ্নীল ভাবের সৃষ্টি করেছিল তা কেবল অনুভব করা যায়। কাউকে বলা যায় না, বলতে মানা।
সেদিনও ঠিক ওই একই রেষ্ট হাউজের বারান্দায় বসে সবাই। কিন্তু সব যেন শূন্য ফাঁকা, সব তেমনি আছে কিন্তু যেন কিছুই নেই। সামনেটা সেদিনের মত জোৎস্নাস্নাত নয়, নিকষকালো অন্ধকার সাথে কেবল সমুদ্রের একটানা গর্জন। ঢেউগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে আর মেঘমুক্ত আকাশে নিরব তারারা তা দেখে মিট মিট করে হাসছে।
ওরা যেন আরিফের জীবনের গল্পটা মনে করে হাসছে।
হটাৎ ভাবনার কণ্ঠে সেই ‘আজ জোৎস্না রাতে’ গানটা শুনে আৎকে উঠলো আরিফ। ঠিক যেন অনন্যা। একই কণ্ঠ একই সুর একই ভঙ্গিমায় বসে আছে।
সে রাতে আকাশ ভরা জোৎস্না ছিল আর সামনে খোলা সৈকত, অনন্যার মুখটাও পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। আর তা সুখ স্বপ্নে ভরা ছিল। কিন্তু আজ আকাশে চাঁদ নেই, সামনে জমাট বাধা অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভাবনার মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না কি আছে তাতে।
অপূর্ব ওর গলা ঠিক মায়ের মত।
-ওই বৃদ্ধের লেখা গান যে এক এক পরিবেশে এক এক ঋতুতে এক এক মনের কাছে এক এক রকম অর্থ বহন করে তা বোধকরি ও নিজেও জানতো না। যেন সব ঋতুর, সব মেজাজের সব কালের মানুষের মনের ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে নিরবে ওর আনাগোনা। ওকে ছাড়া যায় না, ভোলা যায় না। অতীত বর্তমান এবং অনাগত সব প্রজন্মের কাছে অমর তিনি।
গান শেষ করে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সেদিন অনন্যাই বলেছিল কথাগুলো।
-ওহ আজ যদি থাকতো ও! ভাবল আরিফ।
-আচ্ছা দাদিমা, মা ওভাবে চলে গেল কেন! আমার বাবা কি এতই খারাপ ছিল যে ওকে শুধরানোর একটু সুযোগও দেয়া গেল না।
গান থামিয়ে আচমকায় প্রশ্নটা করলো ভাবনা। ওর প্রশ্নে চমকে উঠলেন সালমা বেগম আর শহিদ সরকার। চমকে উঠলো অরিফ ও।
অনন্যা আর আরিফের সম্পর্কের ব্যপারে যে কথাগুলো ভাবনাকে আরিফ বলেছে তাতো অন্য কাউকে বলার কথা না ভাবনার। সে কথাগুলো আরিফ আর ভাবনা ছাড়া অন্য কারো তো জানার কথা না। কারণ সে কাল্পনিক কাহিনীর স্রষ্টা আরিফ নিজে আর শ্রোতা শুধু মাত্র ভাবনা।
আর এই মুহুর্তে কেন! এই খানে বসেই বা কেন এসব প্রশ্ন করছে ভাবনা!
আরিফ তাকালো হতচকিত হয়ে বসা ওর বাবা মায়ের মুখের দিকে।
-ভাবনা মাগো থাকনা ওসব কথা। সব বলেছিই তো তোমাকে আমি, আরো না হয় পরে বলবো। তুমি গানটা আবার গাওনা, এত চমৎকার গলা তোমার।
আরিফের এই ইতস্ততঃ ভাবটা সবাইকে অবাক করলো।
আরিফ ওর বাবা মাকে শুধু বলেছিল- আমার আর অনন্যার মধ্যে সম্পর্কের ব্যপারটা ভাবনাকে আমি যা বলার বলেছি। ও তোমাদেরকে এ ব্যপারে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তোমরাও নিজের থেকে যেন কিছু বলতে যেও না।
-কি বলেছে আরিফ ভাবনাকে ওর নিজের সম্পর্কে? ভাবলেন সালমা বেগম আর শহিদ সরকার।
-আমার বাবার মত এমন একটা মানুষ আমি আর দেখিনি দাদাভাই। তাহলে আমার বাবা এমন কি খারাপ কাজ করেছিল যে আমার মায়ের মত অমন একজন মহিয়সী মহিলা বাবাকে ছেড়ে চলে গেল?
নিরবে কাঁদতে লাগলো ভাবনা।
ফিরে এসে বাবার বলা গল্পটা ভাবনা বললো ওর দাদিমাকে।
অবাক হলেন সালমা বেগম ছেলের মনের বিশালতা দেখে। মেয়ের কাছে মাকে বড় করার জন্য বিনা দোষে ফাসির রশিটা নিজের গলায় পেচিয়ে রেখেছে আরিফ, যার কোন কিছুর জন্যই একটু পরিমাণ দায় দায়িত্ব ওর নেই। ভাইকে বাচাতে, পরিবারকে বাচাতে আর শেষে নিজের স্ত্রীকে বাচাতে নিজেকে বলির পাঠা বানলো আরিফ!
একটা অপরাধ বোধ, একটা অসহ্য যন্ত্রণায় বুকটা ফেটে যেতে লাগলো সালমা বেগমের। মনে হলো এ বোঝা আর একটুও বহন করার সামর্থ তার নেই।
ট্যুর থেকে ফিরে ভাবনাকে সব খুলে বললেন সালমা বেগম। একদম গোড়া থেকে, কোন বিন্দু– বিষর্গও লুকালো না।