বাবা যাচ্ছো কেন!
-বাবা কতদিনে এক বছর ?
যাওয়ার দুদিন আগে আমার শিশু কন্যা যাকে আমরা মাগো বলে ডাকি, সে আমার
কোলের মধ্যে বসে আমার কানের সাথে মুখটা ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে কথাটা জিজ্ঞেস করলো।
আমি কোন জবাব না দিয়ে অন্য কিছু কথা বলে ওকে নিয়ে বড় শপিং মলে গেলাম। এতদিন যে পুতুল,
গাড়ী বা ভিডিও গেমগুলো আজ দেব কাল দেব বলে ঘুরিয়েছি তার সবগুলো ওকে কিনে দিলাম। ব্যাংক
থেকে বেশ কিছু টাকা ওডি নিয়েছি। কারণ এখন আর চিন্তা নেই এগুলো শোধ করতে এক মাসের
বেতনও লাগবে না।
মাগো খুশীতে গদগদ হয়ে থাকলো। কত দিনে যে এক বছর হয় সে চিন্তাটা আপাততঃ ওকে আর দোলা
দিল না।
ওকে খেলনার জগতে বিভোর রেখেই আমি সাত সমুদ্র পার হয়ে মোজামবিকে ইউ এন মিশনে রওয়ানা হলাম।
ও তখন সবে পাঁচ বছরে পা দিয়েছে। আমাদের প্রথম সন্তান ও। হৃদয় নিংড়িয়ে ওকে ভালবাসি আমরা।
ও আসার পর আমাদের সব অভ্যাস সব রুটিনই পরিবর্তন করতে হয়েছে, শুধু ওর সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য।
সন্তান হওয়া কেবলমাত্র মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা এবং সংসারে একজন নতুন সদস্য যুক্ত হওয়াই নয়।
এটা একটা অদ্ভুত অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা। মায়ের উদরে নড়াচড়া থেকে শুরু করে প্রথম যে মুহুর্তে
বিরক্তভরে কপালটা কুচকিয়ে চোখ দুটো মেলে পৃথিবীটাকে দেখলো অথবা প্রথম যেদিন আমার হাতের
আঙ্গুলটা ওর নরম তুলতুলে হাতদিয়ে চেপে ধরলো অথবা যেদিন স্প্রিঙের পুতুলটার নড়াচড়াতে চমকে
উঠে কোলের মধ্যে লুকালো। এমন কত মুহুর্ত কত ঘটনা। সন্তান না হলে যেমন তা পুরোপুরি বোঝা যায়
না তেমনি সে অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার কথা কখনো সবটাই অন্য কাউকে বলে বোঝানো যায় না।
ও আমাদের মেয়ে সন্তান। আদর করে আমি ওকে মাগো বলে ডাকি। সরকারী চাকরী, তায় প্রতি এক
থেকে দেড় বছরেই পোষ্টিং হয়। পাহাড় জংগল যেখানেই পোষ্টিং হয় ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে যায়। ওর কাছ
থেকে ক্ষনেক আনুপস্থিতিও যেন সহ্য হয় না।
কিন্তু সেবার আর কোন উপায় থাকলো না। আমার পোষ্টিং হলো ইউ এন এর আওতায় যুদ্ধবিদ্ধস্ত
আফ্রিকার দেশ মোজামবিকে, এক বছরের জন্য। একেবারে সাত সমুদ্র তের নদী পার।
জীবনের প্রথম ডলারে বেতন পাওয়ার চাকরী। আত্মীয় স্বজন সবাই খুব উত্তেজিত। অনেক টাকা বেতন।
একটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, আমার স্ত্রীও আমাকে শান্তনা দিল। তার উপর এখন থেকে গোনা বেতনের টাকায় টানাটানি করে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হবে না।
মাগো কিছুই বুঝলো না ও সবের। বোঝার মত বয়স ওর হয়নি। তবে বুঝলো কিছু একটা হচ্ছে। কারণ যাওয়ার জন্য অনেক গোজগাজ হচ্ছে। বলতে গেলে ও কিছুটা হতবিহবল। তারপর সময় মত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সব আর সবাইকে রেখে চলে আসলাম অচেনা অজানা স্থানে।
নতুন পরিবেশ, চ্যালেনজীং কাজ। কিন্তু কোন কিছুই যেন আমার মনের উপর কোন আচড় কাটতে
পারলো না।
প্রথম দিন থেকেই মাগোর ঐ কানে কানে বলা প্রশ্নটার উত্তর খুজে ফিরতে লাগলাম। মনে হতে লাগলো
একটা দিনও বোধহয় শেষ হতে চায় না। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। নিজেকে দারুন অসহায়
লাগতে লাগলো। জেলখানার বন্দির মত মনে হলো।
উপাইয়ান্তর না পেয়ে কাজে মন বসানোর চেষ্টা করলাম। প্রতি ক্ষনে ক্ষনে উপলব্ধি করতে লাগলাম মাগোর
প্রতিটি লোম, চুল ওর তুলতুলে হাত পা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, ওর গায়ের গন্ধ।
কোন রকমে দুটো মাস কাটলো। হঠাৎ জানতে পারলাম একটা সি-১৩০ কার্গো বিমান আমাদের দেশে
যাচ্ছে, এখানে যে ব্যাটালিয়ন ডিপ্লয়েড হয়েছে তাদের জন্য গাড়ী আনতে। যাওয়ার পর দেশের
আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ২৪ ঘণ্টা থাকবে লোড হওয়ার জন্য, তারপর আবার সোজা চলে আসবে।
যাওয়ার সময় খালিই যাবে তবে ফেরত আসার সময় যেহেতু গাড়ী লোড থাকবে তায় কেবলমাত্র ৯ জন
প্যাসেঞ্জার আনতে পারবে।
অর্থাৎ যাওয়া আসার সময় বাদ দিয়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য দেশে যাওয়ার একটা সুযোগ ৯ জনের জন্য।
হায়রে মানুষের মন। বুঝলাম আমার মাগোর মত সবারই কেউ না কেউ আছে যারাও আমার মত সঠিক
জানে না একটা বছর কত দিন।
চলিশ্ল জনের সবাই যাওয়ার জন্য মত দিল। কিন্তু যেতেতো পারবে মাত্র ৯ জন। লটারী হলো, ৯ জনের
মধ্যে আমিও একজন ভাগ্যবান হওয়ার সুযোগ পেলাম।
আহ কি অমৃত স্বাদে দেহ মন পশ্রান্তিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো।
যারা যেতে পারলো না তারা সকলেই ছোট বড় অনেক গিফট ওদের আপজনদের জন্য সাথে দিয়ে দিল।
সহগামী অন্যান্যদের মত তার একটা বড় অংশ আমি খুশী হয়ে গ্রহন করলাম। পরিবহন কোন সমস্যা নয় কারণ অত বড় বিমানটাতো খালিই যাচ্ছে। চিন্তাটা ওগুলো বিতরনের। যাহোক সবাই নিজ নিজ বাসার
ঠিকানা আর টেলিফোন নং লিখে দিল।
প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ধরে বিমানটা সরাসরি উড়ে দারেস সালাম আর কলোম্বতে যাত্রা বিরতি করে দুপুর বারোটার দিকে দেশে পৌছালো। বিমান বন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেরুতে বেরুতে দুপুর গড়িয়ে
গেল।
রিসিপশানে অনেক মানুষের ভীড়ে দাড়ানো আমার স্ত্রি সাথে ওর হাত ধরে গা ঘেসে দাড়ানো মাগো।
উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে চারিদিক দেখছে।
হলুদ রংএর কারুকাজ করা ফ্রক পরনে আর পোশাকের সাথে মিলিয়ে মাথার ডান দিকে চুলে ফুল গোজা।
ওকে দেখে মনে হলো স্বর্গ থেকে বিধাতা এক অপসরী পাঠিয়েছে তাঁর দ্যূত হিসাবে আমাকে অভ্যর্থনা
জানাতে।
কিন্তু একি, অভ্যর্থনা করতে এসে ও আমাকে চিনছে না। আমার মাগো আমাকে চিনছে না! ও অবাক
হয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে, তার মধ্যে আমিও একজন।
আমার স্ত্রী ও অন্য্যান্যদের সাথে নুন্যতম কুশলাদি বিনিময় করে মর্তে নেমে আসা অপসরীকে আদর
করে কোলে নিতে যেয়ে দেখলাম এই দুই মাসের ব্যবধানে ওর সাথে অনেক ব্যবধান তৈরী হয়েছে।
মাগো আমার কোলে কিছুতেই আসলো না। সবাই হাসাহাসি করলো খানিকটা। ভাবলাম অভিমান, কিন্তু
অভিমান করার বয়সতো ওর হয়নি। বুঝলাম এই দুই মাসেই প্রাকৃতিক নিয়মে মাগো আমার তার নিজের
মত করে অন্য একটা জগত গড়ে নিয়েছে। ভাবলাম মহাপরাক্রমনশালী বিশ্ব নিয়ন্তা পরিবেশ পরিস্থিতির
সাথে খাপ খাওয়াতে সিদ্ধহস্ত, আর তারই ছোয়া লেগেছে আমার মাগোর মনে আমার এই দু মাস
অনুস্পস্থিতির মধ্যেই।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। ওদেরকে নিয়ে আর অন্যান্য সবার গিফট সামগ্রী সহ একটা
মাইক্রোবাসে উঠলাম। বাসায় পৌছাতে প্রায় আধা ঘণ্টা লাগলো। আর এরই মধ্যে মাগোর সাথে আবার
পুরনো সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলো। সারা পথটুকু ও আমার বুকের মধ্যে মুখ গুজে নানা কথা জিজ্ঞেস
করতে লাগলো।
বাসায় পৌছে গাড়ী থেকে নামতে নামতে এই প্রথম মনে হলো আগামী কাল প্রায় এ রকমই সময়
আমাকে ফিরে যেতে হবে। বুকটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলো।
আমার স্ত্রীর সাহায্য নিয়ে সবার গিফট আইটেমগুলো এক এক করে আলাদা করলাম। ধারে কাছে বা
একই এলাকাতে যেগুলো তা আলাদা করে বাকিগুলোর জন্য এক এক করে সবাইকে ফোন করে বাসার
ঠিকানা দিয়ে সংগ্রহ করতে বললাম।
ধারে কাছের গিফটগুলো যথাসম্ভব ঐ দিনের বাকি সময়টুকু আর পরদিন সকালে বিতরনের একটা
পরিকল্পনা তৈরী করলাম। এরই ফাকে ফাকে আত্মীয় বন্ধুদের মধ্যে যার যার সাথে দেখা করা দরকার
তা সেরে ফেলারও মনস্ত করলাম।
ভাবলাম হাতে যেহেতু সময় কম আর সময়ের একটা বড় অংশ গিফট বিতরনের চলে যাবে তায় সারাক্ষন
মাগোকে সাথে রাখলাম। ঐ দিন প্রায় রাত এগারোটা আবার পরদিন দুপুর বারোটা পর্যন্ত সারাক্ষন
মাগোকে সাথে নিয়ে নানান জায়গা ঘুরলাম। একটুও কোন অভিযোগ করলো না ও বা কোন ক্লান্তিও যেন
ওকে স্পর্শ করলো না।
কত কথা হলো ওর সাথে যার কোন তালিকা করা যায় না। আমি কেবলই কিছুক্ষন পর পর কথার ফাকে
ফাকে ওকে বললাম – মাগো কয়েকঘণ্টা পরেই আমি আবার মোজামবিক চলে যাব।
আমার চলে যাওয়ার প্রসঙ্গটা কিছুতেই ওর মাথার মধ্যে প্রবেশ করানো গেল না। আমার স্ত্রীও একটু
অবাক হয়ে আমার চলে যাওয়ার ব্যপারটা ওর কাছে বোধগম্য করার প্রয়াস পেল। কিন্তু কিছুতেই কিছু
হলো না।
আমার চলে যাওয়ার প্রসঙ্গটা মাগোর মাথায় ঢুকানোর প্রয়াসে বস্তুতঃ আমার আর আমার স্ত্রীর মাথায়
আরো বেশী বেশী করে বিষয়টি গেথে যেয়ে সময়ের অনেক আগে থেকেই আমাদেরকে মর্মবেদনায় জর্জরিত করতে লাগলো।
অবশেষে চলে যাওয়ার সময় আসলো। সবাই হাসি মুখে বিদায় দিল। বুঝলাম আমার স্ত্রীও অনেক কষ্টে
মুখে হাসি বজায় রাখলো।
গাড়ী দাড়িয়ে বাড়ীর সামনে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে।
দিনমনি নিস্তেজ হয়ে ডুব দেয়ার ঠিক আগে শেষবারের মত প্রিয় পৃথিবীকে দেখে নিচ্ছে প্রাণভরে। মাগো
আমার স্ত্রীর কোলে বসে সব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
আমার সাথে গত দুদিন ধরে এত ঘোরাঘুরি করার পরও ক্লান্তির কোন ছায়া পড়েনি ওর চোখে মুখে।
কোন ভাবাবেগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না ওর মধ্যে।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে ওকে আমার স্ত্রীর কোল থেকে নিয়ে শেষবারের মত একটু আদর করতে
চায়লাম। কিন্তু ও গতকাল এয়ারপোর্টের মত আমার কোলে আসতে অসম্মতি জানালো।
এবার আগের মত অন্যান্যরা হাসলো না। কিন্তু আমি হাসার চেষ্টা করলাম। মনে মনে সব কিছুর নিয়ন্তা
ঐ মহপরাক্রোমশালীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম – হে বিধাতা, হে মহাসন্ময়কারী, আমার ঐ অবুঝ
মাগোকে আমার অনুপস্থিতিতে দিন কাটানোর সহায় হয়েছ। ধন্যবাদ তোমাকে।
বুকভরা একটা নিঃশ্বাস টেনে গাড়ীতে উঠে বসলাম।
কি যে হতে লাগলো মনের ভিতর বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ করে নির্লিপ্ত ভাবে মায়ের কোলে বসা মাগো ওর তুলতুলে হাতদুটো বাড়িয়ে গুমরে ওঠা কান্নার শব্দ
করে বললো – বাবা তুমি যাচ্ছ কেন?
মূহুর্তে আমার কান বন্দ হয়ে গেল। হাত পা সব অবস হয়ে আসতে লাগলো।
আকাশে বাস তোমার হে মহাকর, মাটির মানুষ আমি মাটির ঘর আমার
জিজ্ঞাসা তোমার কাছে জানিনা তোমার মনে কি আছে
প্রশ্নটা ক্ষুদ্র হেন বাবা তুমি যাচ্ছ কেন?
আমার চেয়ে তোমার কাছে
আপন কেউ আছে কোন?
সব কোলাহল কুজ্ঞন সব ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান
স্তব্দ হল কানে ও মনে।
একি যন্ত্রনা একি টান
পেষন করিছে জনে জনে।
কেন কর এ নরাধমে হেলা তোমার এ পরীক্ষা নেয়ার খেলা
একটা উত্তরও যার নেই জানা।
প্রাণ দিলে যারে কেন দিলে এত জ্বালা তারে
পাথর বানাতে ছিল নাতো মানা।
সমগ্র বিশ্বের ঘরে ঘরে সবাইকে টানিছে এসব যাদুকরে
সব বাবাকে – মানুষ ও প্রাণীকে।
কিন্তু ওরা যে জেলে বাধা শক্ত শেকলে
জানে যেতে যে হবে তারে চলে ঐ পরপারে ।
পৃথিবীর অবুঝ যাদুকর অদম্য টান বিধাতার
অবুঝ অদম্যের টানে হায় এ অধম অসহায়!
যেতে দিবে না তাকে যেতেও চায় না সে হেতা থেকে
যদিও জানে তার হবে হার যেতে হবে সবার।
Category: Bangla, Short Story