পরশদের বাড়ীটা প্রকৃতঅর্থে উপশহর এলাকায়। জমিদার বংশ ওদের। সেই অর্থে জমিদারী না থাকলেও ঐশ্বর্য্য আর প্রতিপত্তি আছে। ওর বাবা আকবর জোয়ারদার সে অঞ্চলের খুব নামকরা ব্যক্তিত্ব। সমাজ সেবক হিসেবে বিশেষ সুনাম আছে। এখনো অনেক জমির মালিক, তাছাড়া কয়েকটা মিল কারখানার মালিক ওর বাবা।
আরিফ সরকার সেবার প্রমোশান পেয়ে এডিসি হিসেবে যোগ দিয়েছেন ওই জেলা শহরে। আর সে পরিচয় ধরেই আকবর জোয়ারদারের সাথে টেলিফোনে এ্যাপোন্টমেন্ট করেই মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওদের বাড়ীতে।
পুরো টার্মের পড়া পরশের খাতা থেকে লিখে নেয়ার যে রূটিন পরশ দিয়েছিল সেটা যত সহজে ও বলেছিল ভাবনার কাছে তা অত সহজ ছিল না। তায় ওরা ভেবেছিল ছুটির দিনে ওদের বাসায় বসে পড়াগুলো লিখে নেবে ভাবনা।
সত্যি বলতে ভাবনার জন্য এধরণের পন্থা অবলম্বন করতে অভ্যস্ত আরিফ। কারণ প্রায় প্রতিবারই শিক্ষ্মাবর্ষ শুরূ হবার পর পোষ্টিং হলে এমনটি করা ছাড়া উপায় থাকে না ওদের।
বাবার সাথে করেই ওদের বাড়ীতে প্রথম যাওয়া ভাবনার।
পুরোনো জমিদার বাড়ী। প্রায় দু’শ বছরের পুরোনো। এর প্রতিটি ঈট যেন ইতিহাসের এক একটা পাতা। প্রায় ত্রিশ একর জমির মাঝখানে চুন সুড়কির গাঁথা বিশাল বাড়ীটা। বাইরেটা অবিকল তেমনি থাকলেও ভেতরটায় যুগ পরিবর্তনের ক্রমধারা সুস্পষ্ট।
মৌসুমী ফুল আর ফলের সমারোহ বাড়ীটা ঘিরে। উঁচু প্রাচির ঘেরা আঙিনার ভেতরে বেশ কয়েকটা বড় বড় দিঘী আর সে গুলোর মাটি দিয়ে উঁচু করা জায়গার উপর নির্মীত বাড়ীটা।
বসত বাড়ী থেকে একটু দূরে সীমানা প্রাচীরের গা ঘেঁসে দাড়ানো বড় একটা পুরোনো হাসপাতাল। পরশের দাদার আমলের ওটা। ওখানে চিকিৎসা হয় বিনা মূল্যে। সাধারণ সব ধরণের ঔষধ পত্রও বিনা মূল্যে দরীদ্র মানুষদের দেয়া হয়।
বসত বাড়ী আর হাসপাতাল বাদে বাকি জায়গা জুড়ে গাছ গাছালী। যত জাতের ফলের গাছের নাম করা যায় তার সবকটিই আছে ওখানে। বছরের এমন কোন সময় নেই যে ওদের বাগানে কোন না কোন ধরণের ফল না পাওয়া যায়।
মোটা মোটা শাল শেগুনের গাছগুলো বংশের শত বছরের ইতিহাস হয়ে স্বগর্বে মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে আছে। আরও আছে ঔষধি গাছের এক মহা সমারোহ।
-বৃক্ষপ্রেমিকের স্বর্গ রাজ্য বলা যায় এটাকে।
আরিফের মন্তব্য আর তার প্রকৃতিপ্রেম মুগ্ধ আর অনুপ্রাণিত করলো আকবর জোয়ারদারকে।
প্রতিদিন ভোরে ওই বৃক্ষরাজীর স্বর্গরাজ্যে বিচরণ করে নিজের অস্তিত্ব আর পূর্ব পুরুষদের যেন নতুন করে খুজে দেখেন আকবর জোয়ারদার।
আরিফকে তাদের পুরো বাগান বাড়ী সোৎশায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতেই বেলা গড়িয়ে গেল।
-আপনার এ ঐশ্বর্য্য এক দুদিন কেন সারা জীবন ধরে দেখলেও দেখে ফুরোনো যাবে না। প্রকৃতি এখানে কথা বলে, প্রতিদিন নতুন নতুন সাজে সেজে নতুন কথা বলে।
আরিফকে খুব পছন্দ হলো আকবর জোয়ারদারের আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো ওদের ভিতর।
ওরা যে প্রায় বছর খানেক ওই শহরে ছিল তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে— বাবা ওকে সাথে নিয়ে যেত ওদের বাড়ীতে। সারা দিন গড়িয়ে কখন যে সন্ধ্যে গড়াত তা কারোরি খেয়াল থাকতো না।
পরশের মা রাজিয়া জোয়ারদারও খোলামেলা মনের মানুষ। কিন্তু একটু অমনোযোগী আর অন্যমনস্ক মনে হত তাকে। সবার সাথে বসে কথা বলছেন হাসছেন কিন্তু থেকেও যেন নেই, মনে হত এ সব কিছুর আড়ালে ওর মনের ভিতর অন্য একটা কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে।
কতদিন পর এই হটাৎ করে দেখা ওদের। পরশ ওর সিটে আর ফেরত গেল না। হারিয়ে যাওয়া সেই বাল্য স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ওরা গন্তব্যে এগিয়ে চললো।