শরীরটা ইদানিং একদম কথা শুনতে চায় না। মনটাও কেন জানি ভাল না। কোথায় কিছু একটা যেন নেই। কাজ কর্ম একটু কম থাকলে, ব্যস্ততা না থাকলে এমনটা হয়। অজানা একটা অতৃপ্ততায় বুকটা ভরে থাকে।
রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে খোলা জানালার পাশে দাড়ায়। জনশুণ্য গাড়ীঘোড়াবিহীন ফাঁকা রাস্তা গুলোর দিকে তাকালে বুকের ভিতর কান্নার শব্দ শুনতে পায়। সব কিছুই কেমন যেন নিরর্থক লাগে।
তেমন বড় ধরনের কোন সমস্যাও বর্তমানে আমার নেই। এই পড়ন্ত বয়েসে তেমন কোন চ্যাঁলেঞ্জও নেই; যেমন সন্তানদের বড় করা বা আর্থিক দৈন্যতা ইত্যাদি। লম্বা চাকরী শেষে অজস্র বিশ্রাম এখন। তবে কেন এই অতৃপ্ততা! অনেক করে ভেবেছি কিন্তু উত্তর খুঁজে পায়নি।
জীবিকার তাড়নায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে, ভিন শহরে শহরেই জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। সেখানে কত কাজ কত ব্যস্ততা, আলোয় সব ঝলমল করে। সবার দৃষ্টি কেবল সামনের দিকে, উপরের দিকে। সামনে যাওয়া আর উপরে উঠাই যেন জীবনের একমাত্র ব্রত সেটাই সাফল্য।
কিন্তু এখন সে সব ব্যস্ততা শেষ। হিসেব মিলানোর জন্য যথেষ্ট ফুসরত।
বাড়ীতে যাওয়ার জন্য মনটা আনচান করে। বাড়ী বলতে আমার পিতৃপুরুষের বাড়ীর কথা বলছি, সেখানে আমার জন্ম, আমার ছেলেবেলা লুকিয়ে আছে। ‘মেহের কুজ্ঞ’ আমাদের বংশ পিতার নামেই বাড়ীটা। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে প্রকৃতির অরণ্যে ঘেরা সে বাড়ী। দোতলা, চারিদিকে প্রায় বুক অব্দি উচু বারান্দা ঘেরা। বাড়ীটার নিচ তলায় রান্না ঘরের সাথে ডাইনিং স্পেস সহ গেষ্ট রুম আর বড় একটা ড্রয়িং রুম বাদে আরো দুটো শোয়ার ঘর। ঊপরে প্রশস্ত সাদের ঠিক মাঝখানে একটা বাথ আর ছোটো কিচেন সহ একটা বেড রুম।
ঘরগুলো খুব একটা খোলা হয় না বললেই চলে। তালাবদ্ধই থাকে।
কিন্তু একি? হিসেব মিলছে না! সব যেন কেমন এলোমেলো। সময়ও ফুরিয়ে যাচ্ছে।
বাড়ী ফেরার মনস্থ করলাম এবং এখনই একেবারে ভরা বর্ষায়।
বর্ষা পুরোদমে শুরু হওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, গুড় গুড়ুম করে মেঘের গর্জন, ঝাপটা হাওয়া, আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলকানি। যাকে বলে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।
ভালোই হলো, কারণ নীরবে নিভৃতে মেহের কুঞ্জে বসে বর্ষা দেখা অর্থাৎ নিজেকে নিজের সামনে দাড় করিয়ে দেখার মানষিকতা নিয়েই এবার এসেছি।
বাড়ী পৌছাতে দুপুর গড়িয়ে গেল বলা যাই একদম শেষ বেলায়।
তিন দিকে মেহেগুনি বাগানে ঘেরা, শুধু সামনে অর্থাৎ উত্তর দিকটাতে বড় সবুজ ঘাসে ভরা লন। অপূর্ব প্রকৃতি ঘেরা আমার মেহের কুঞ্জ।
মাঝে মধ্যে আসলে সোজা উপরে উঠে যায়। বিশাল খোলা ছাদের মাঝখানে ঘরটা। চারিদিকে খোলা। পুরো ছাদটা কোমর অব্দি উচু রেলিং দিয়ে ঘেরা।
প্রায় নয় মাস পর এবার আসা। কাজের ছেলেটাকে সাথে নিয়ে উপরের ঘরটা ঝাড়া মোছা করে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করছি।
ঝাপটা বাতাসে কচি কচি সবুজ পাতার বাহারে সেজে গুজে মেহেশুনির ডাল গুলো দুলছে। একতলার ছাদ হলেও পুরানো ধাঁচের বাড়ী তায় ছাদটা এযুগের ছাদের তুলনায় বেশ উঁচু। তাছাড়া বাড়ীটা প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু বারান্দার উপর তৈরী বিধায় একতলা ছাদটা কম করে দেড় তলার মত উঁচু। ছাদে দাড়িয়ে ইচ্ছা করলে মেহেগুনির ডাল পাতা গুলো ছুঁয়ে দেখা যায়।
মনে হছে একটা মাতনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। অপেক্ষা শুধু একটা ঈশারার।
আমিও প্রস্তুত।
– বারান্দায় চেয়ারটা পেতে তুই যা।
আমি জানি উল্লেখ করে না বললেও ছেলেটা নিচ তলার পশ্চিম দিকের বারান্দায়ই ইজি চেয়ারটা পাতবে।
সাধারণতঃ ঐ খানটায় আমি বসি। চারদিক ঘোরানো বারান্দার উপর একচালার আদলে কৌনিক ভাবে ঝুলানো ছাদ, উপরের পিটটা সিমেন্ট কেটে কেটে বাংলা টালির মত করে তৈরী। বারান্দার ঐ খানে বসলে সবুজ লন আর মেহেগুনি বাগানটা ছাড়াও মেইন গেটটার ফাঁক দিয়ে দুপাশে সবুজ গাছের চাদোয়াই ঢাকা কালো পিচ ঢালা সরু রাস্তাটা দিগন্ত অব্দি দেখা যায়।
এখানে বসলে যেন পুরো পৃথিবী দেখা যায়।
সিড়ি দিয়ে উঠা নামা করতে আজকাল বেশ কষ্টই হয়। মন চাইলেও শরীরটা একদম সাই দিচ্ছিলো না।
কিন্তু না- নামতে আমাকে হবেই। এবার যে আমি প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি।
বারান্দায় পাতা ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিলাম।
সব কটি দ্বার দিয়েছি খুলিয়া,
জীবন জীবিকা সবই ভূলিয়া।
দেহ মন আমরা সবাই
আজি শুধু তোমারই অপেক্ষায়।
একটানা বর্ষনের শব্দ, বাতাসের ডালঝাকানি, বয়ে যাওয়া বর্ষার পানির কুলকুল শব্দ, সব মিলে মূক প্রকৃতি যেন সরব হয়ে উঠেছে। সবাই যেন নিজের কথা বলতে ব্যস্ত। সবাই কেবল বলছে।
মুসল ধারে বৃষ্টি শুরু হল। যত ধুলো বালি, পাকা পঁচা পাতা, যা কিছু নোংরা সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনের সব কথা, দুঃখ বেদনা সব কিছু ধুয়ে মুছে পাক পূত হওয়ার আনন্দে সবাই বলতে ব্যস্ত।
বৃষ্টির স্যাঁ স্যাঁ শব্দে এক অভূতপূর্ব সুর মূর্ছনায় সবই নিমজ্জিত।
কিন্তু একি এগুলো কাঁন্নার শব্দের মত মনে হচ্ছে কেন!
একটু ভালো করে খেয়াল করার জন্য কান পাতলাম।
কান্নার শব্দটা মনে হচ্ছে কেবল একটা কণ্ঠ থেকে বেরোচ্ছে না। সমস্বরে অনেক গুলো কণ্ঠ থেকে একসাথে বেরুচ্ছে।
সবই কাঁদছে! প্রকৃতি কাঁদছে যে যার মত করে। শব্দগুলো ভিন্ন কিন্তু সুরটা একই। নিজের বুকে কান পাতলাম।
একি ঐ একই সুর! একই কান্না!
কেন এ কান্না, কিসের জন্য কান্না!
দমকা বাতাস মাঝে মাঝেই বৃষ্টির ছিটা চোখে মুখে বুলিয়ে দিচ্ছে। হটাৎ করে মনে হলো কে যেন আমার মুখে কপালে হাত বুলিয়ে দিল। যেন যাদুর পরশ! আহ কি প্রশান্তি! চোখ বন্ধ হয়ে ঘোর নেমে আসলো।
অভূতপূর্ব একটা ঘ্রান নাকে এসে লাগলো। ঘোরটা ভেংগে গেল, খুব বিরক্ত লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে প্রতিবাদ করলাম।
বিরক্তির সাথে ঘোরের মধ্যেই চোখদুটো মেলে ধরলাম।
কি অপূর্ব এ দৃশ্য! স্বর্গীয় এক মূর্তি সামনে। চোখ ফেরানো যায় না। সারা শরীর মনে শিহরণ জাগলো। প্রথম দেখাই ওর প্রেমে পড়ে গেলাম, চোখ দুটো বন্ধ করার চিন্তা ভুলেই গেলাম।
একি যাদুকরী প্রেম! মর্তের সাথে স্বর্গের প্রেম!
সরু আঁকাবাকা হয়ে বয়ে যাওয়া একটা নদী, নৌকাতে শুধু ও মানে আমার স্বর্গীয় অতিথি আর আমি। মাঝি নেই, বৈঠাও নেই। নদীর একটানা নিরবিচ্ছিন্ন স্রোতেই ভেষে চলেছি। স্থিরও না দ্রুতও না- একটানা সে গতি।
কোথায় চলেছি, কেন চলেছি জানি না। শুধু একটায় বাসনা বুকে- স্বর্গীয় অতিথিকে সুখী করতে হবে ।
দৃষ্টি সারাক্ষন শুধু ওর দিকেই নিবদ্ধ। সব চিন্তা সব কামনা বাসনা শুধু ওকে নিয়েই এবং ওরই জন্য। কিন্তু ওর দৃষ্টি দূর দিগন্তের দিকে। ভাবলেশহীন! তবে এক যাদুকরী আকর্ষন আছে ওর সবকিছুতেই।
দিন যেয়ে রাত এলো, আবার আঁধার ঠেলে চাঁদ উঠলো। কত জানা অজানা ঘাটে ভিড়লো আমাদের নৌকা। ওকে সাথে নিয়ে, বুকের ভিতর আঁকড়ে নিয়ে ওকে খুশি করার আনন্দে মেতে উঠলাম। কতকিছু নিলাম, কতকিছু দিলাম!
ছুটলাম মাঠে ঘাটে সমতলে পর্বতে
যৌবনে বার্ধক্যে, দিনে রাতে।
ও একটি বারের জন্যও আমার দিকে তাকালো না, একটু ঈশারা পর্যন্ত করলো না।
কত ঘাট বন্দর থেকে নানা সম্ভারে নৌকাটা বোঝাই করলাম। আশা শুধু একটায়, ঐ স্বর্গীয় অতিথির সুখ।
কতবার কতভাবে সকল জানা ও শোনা সুরে
শুধালাম তারে কত আকুতি করে।
দিয়েছি শুন্য করে যা ছিলো সম্বল মম
ক্লান্ত অবসন্ন আমি একটু তাকাও একটু থামো ।
এখন আমি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। আমি যেন সমস্ত দৈহিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। একটুও এগোতে পারছি না, পিছানোরও পথ নেই। নিজেকে নিজের কাছেই বোঝা মনে হতে লাগলো।
অতি কষ্টে চোখ দুটো আরো একটু খুলে ওকে দেখার চেষ্টা করলাম। সবকিছু ঝাপসা, শুধু ওর উপস্থিতিটা বোঝা যাচ্ছে।
আহ! একি আকর্ষন ওর। এ টান, এ আহবান উপেক্ষা করার সাধ্য কার?
হটাৎ করে মৃদু মন্দ বাতাস বইতে শুরু করলো। একটা মাদকীয় গন্ধ ভেষে আসতে লাগলো, পাগল করা সে গন্ধ। এ গন্ধ সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার কাছে। চোখ দুটো আর খুলে রাখতে পারছি না।
বুঝতে পারলাম সহশ্র নদী ঘুরে আমাদের নাও মহাসমূদ্রের কাছাকাছি।
এখনই সময় মহামিলনের।
সারাক্ষন বুকের মাঝে বসি ধুকধুকিয়ে বলেছ দিবা নিসি
ফিরে চল মানিক আমার।
এপারে যা কিছু, ধাবিছ পিছু পিছ্ সব মিছে সোনা মধু, মরিচিকা শুধু
আবাস যে ওপারে তোমার।
কে যেন আনমনে বলে কানে কানে
শোণ! অমৃতের খোজ পাবে না এ জীবনে।
সে স্বাদ যে কেবল মরণের মাঝে, স্বর্র্গের জিনিস মর্তে কি সাজে!
মর্তে বসে আমি, হায় অন্তর্যামী! স্বর্র্গের জিনিস খুজেছি এ ভূবনে!
বুঝিলাম অবশেষে জীবন সায়াহ্নে এসে
দূরে রাখি ঠেলে যারে সারাক্ষন, সেই যে ওরে অতি আপন জন!
বুঝতে পারছি আমাদের এ মিলনেই সাঙ্গ হবে সব জ্বালা যন্ত্রণা, সব চাওয়া পাওয়া। বুঝলাম আমার স্বর্গীয় অতিথি ঘুরে তাঁকিয়েছে আমার দিকে। ভাবলাম এইতো সময় হিসেব মিলানোর।
ওর চোখ দুটো দেখার চেষ্টা করলাম। আহ কতদিনের অপেক্ষা!
কিন্তু একি সবই তো অন্ধকার! এক মাদকীয় গন্ধে জ্ঞান হারালাম।
যত শ্রম, যত চেষ্টা ম্ পাপ বা পূণ্য
সোনা মানিক! সবইতো তোমারই জন্য।
জানো তুমি স্বর্গীয় আত্মা, জানে বিধাতা।
স্বর্গ থেকে এসেছিলে স্বর্গে যাবে চলে
মর্তের তাকে, মাটি নেবে বুকে
হায়! আমি যে কে তা, কেউ গেলেনা বলে সেকথা।
জীবন সায়াহ্নে হিসাব মিলায়, কি তাঁকে দিলাম, কি সে চায়!