অনেকদিন হয়ে গেল অমর বিয়ে করেছে কিন্তু কোন ছেলেপুলে হয় না। তাতে করে অবশ্য অমরের তেমন মাথা ব্যথা নেই, মাথা ব্যথাটা শুরু হল ওর স্ত্রীর তরফ থেকে। বিষয়টি মূলত প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনদের মন্তব্য আলোচনা সমালোচনা থেকেই জন্ম। বলা বাহুল্য, এ ধরনের মন্তব্যের মুখোমুখি অমরও হয়ে থাকে কিন্তু ও ওর ব্যক্তিত্ব দিয়ে সেগুলো অগ্রাহ্য করে। যেটা ওর স্ত্রী অধরা পারে না।
যাহোক, বিশেষ করে স্ত্রী অধরার চাপাচাপিতেই অমর একটা অনাথ শিশুকে দত্তক নিতে সম্মত হল। নাম পরিচয় বিহীন অনাথ শিশু, নাম রাখল সূর্য।
সূর্যকে কোলে তুলে নিয়ে অধরার পিপাসিত মন যেমন কিছুটা তৃপ্তি পেল তেমনি ওকে লালন পালন করা নিয়েও নিজেকে ব্যস্ত রাখার একটা উপায় খুজে পেল অধরা।
বেশ চলছিল সবকিছু ভালভাবেই। কিন্তু সূর্যকে দত্তক নেয়ার দু’বছরের মাথায় অনেকটা অনাক্ষিত ভাবে অধরা সন্তান সম্ভবা হল এবং ঠিক সময় মত একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। ওরা দ্বিতীয় সন্তানের নাম রাখল রবি।
দুই সন্তান যেন ওদের দু’চোখের মনি। একে অপর থেকে আলাদা করা অসম্ভব। আর নাম দুটো এমন ভাবে রাখল যে শব্দ আলাদা হলেও দুটো শব্দের অর্থ এক।
সূর্য আর রবি সমান ভাবে মা বাবার স্নেহে বড় হয়ে উঠতে লাগলো।
অমর আর অধরা তাদের দুই ছেলের মধ্যে কোন পার্থক্য না করলেও সমাজের মানুষ আর বিশেষ করে আত্মীয় স্বজনদের কানাঘুষাতে সূর্যের পরিচয় সমাজের চোখে দত্তক ছেলে হিসেবেই গণ্য হয়ে থাকল।
মা বাবার সমান আদর স্নেহে দু’ভাই বেড়ে উঠলেও দুজন যেন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। সূর্য যেভাবে পড়াশোনাই মনোযোগী আর আদর্শবান হিসেবে বড় হতে লাগলো, রবি ঠিক যেন তার উল্টো, পড়াশোনাই পুরোপুরি অমনোযোগী, ভীষণ আবেগী, স্বার্থপর ও বকাটে হয়ে উঠতে লাগলো দিনে দিনে।
ক্লাসে পরিক্ষায় রবি একের পর এক ফেল করে করে শেষ পর্যন্ত লেখা পড়াই ছেড়ে দিল। অমর যথাসাধ্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলতে গেলে হাল ছেড়ে দিল।
ওদিকে ভাল ফলাফল করার বদৌলতে সূর্যকে অমর রাজধানী শহরের নামকরা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করল।
এ ব্যাপারে রবির মামা আর চাচারা দারুন ভাবে আপত্তি জানালো। রবিকে ঠিক মত মানুষ না করতে পারাতে তারা মন্তব্য করতে লাগলো যে –নিজের ছেলেটা গোল্লায় যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল না করে দত্তক ছেলের পিছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালছে অমর। এটা ধর্মে সইবে না।
সমাজের লোকজনও এ ধরনের মন্তব্যের সমর্থনে যোগ দিল।
বিষয়টি আরো প্রকট হয়ে উঠলো যখন মামা চাচাদের পরামর্শে এবং উৎসাহে পড়াশোনা ছেড়ে রবি চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার মনস্ত করল।
-নিজের ছেলেকে যখন পড়াশোনা ঠিকঠাক মত করাবেই না, তখন ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দিক, তাহলে ছেলেটা ভাল আয় রোজগার করে নিজের পায়ে দাড়াতে পারবে।
আপন আত্মীয় ও পাড়া প্রতিবেশীদের প্রস্তাব অমর ইতিবাচক হিসেবে গ্রহন করল। কিন্তু ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে হলে অনেক টাকার প্রয়োজন, এ সময়ে কি ভাবে জোগাড় করবে অতো টাকা! ভাবল অমর।
সূর্যকে হোস্টেলে রেখে পড়ানোর জন্য এমনিতেই বেশ টাকা খরচ করতে হয় তার উপর রবিকে বিদেশে পাঠানোর জন্য টাকা জোগাড় করা অমরের জন্য অসাধ্য হয়ে দাড়াল।
-শোন অমর, সূর্যকে তোমরা দত্তক নিয়েছ, অনাথ ছেলে, ওকে মানুষ করা তোমার জন্য মানবিকতার কাজ ছাড়াতো বেশী আর কিছু না। সেটা তুমি করছ, ভাল কথা। কিন্তু রবি তোমার নিজের ছেলে ওকে মানুষ করে জীবনে প্রতিষ্ঠা করা তোমার কর্তব্য, এটা ধর্মের কাজও বটে। ভুলে যেও না তুমি ওর জন্মদাতা। অন্য কিছুর দোহায় দিয়ে এ দায়িত্ব তুমি এড়িয়ে যেতে পার না। সমাজ সেটা মেনে নেবে না।
রবির বড় মামার মন্তব্যে অমর বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবল। রবিকে বিদেশে পাঠানোর টাকা দিতে হলে সূর্যকে ইউনিভার্সিটির পড়া থেকে বাদ দেয়া ছাড়া অন্য পথ নেই। বরাবরের মত ইউনিভার্সিটিতে সূর্য ভাল রেজাল্ট করছে কিন্তু তখনও ওর আরো দুই বছর বাকি পড়া শেষ করতে। এ সময়ে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটলে ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। কথাটা ভাবতে অমরের বুকটা কেপে উঠলো।
-কি করবে অমর?
অধরার সাথে কথাটা একান্তে আলোচনার জন্য রাতে প্রসঙ্গটা পাড়ল।
-আমি যখন সদ্য প্রসুত রবি আর দু’বছরের সূর্যকে আমার দু’পাশে রেখে ওদেরকে আদর করতাম, তখন মা হিসেবে একবারও মনে হয়নি কে আমার শরীর থেকে বের হয়েছে আর কাকে দত্তক দিয়েছি। তুমি যদি আমাকে বল যে আমার দুটো চোখের মধ্যে যে কোন একটি চোখ বিসর্জন দিতে হবে এবং বিসর্জনের জন্য চোখটা আমাকেই বাছাই করতে হবে। এ বাছাই আমি করতে পারব না অমর। তুমি আমায় ক্ষমা কর।
কথাটা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো অধরা।
-বিশেষ করে আমার বাবা আর ভাইয়েরা আমাকে অনেকবার আপন পরের সংজ্ঞা বিষদ ভাবে বর্ণনা করে, ধর্ম অধর্মের কথা বলে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। আমি তাদের কোন কথার জবাব দিই নি। কারন তাদের কথাগুলো ছিল তাদের মনের, হিসেবের কথা, তাই সামাজিক যুক্তির শক্ত ভিতের উপর দাঁড়ানো। কিন্তু আমার ছেলেদের স্থান আমার মনে নয়, অন্তরের গভীরে। কি করব আমি সেটা তুমিই বলে দাও।
কান্নাই ভেঙ্গে পড়লো অধরা।
অনুভব মানুষের অন্তরাত্মার প্রকাশের মাধ্যম। আর অনুভবের অবস্থান মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের আওতার অনেক ঊর্ধ্বে। অন্তরের সাথে বিশ্ব বিধাতার সরাসরি যোগাযোগ। মানুষের অন্তর যুক্তি অন্ধ। কি করবে এখন অধরা, কি জবাব দেবে স্বামীর কথার।
স্ত্রীর কথায় অমর কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে রইল।
-জান অধরা, এখন আমি যদি সবকিছু যেমনি চলছে তেমনি চলতে দিই, অর্থাৎ রবিকে বিদেশে পাঠানোর টাকা না দিই, তাহলে সমাজ আর আত্মীয় স্বজনের চাপ আমাকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকবে। সূর্যের জন্য যা করছি সেটা ওর প্রাপ্য আর সেটা করার জন্য সমাজের কোন অনুশাসনের প্রয়োজন নেই। সেখানে আছে কেবল হৃদয়ের টান। আর আমি এটাও বুঝতে পারছি যে, রবিকে টাকা খরচ করে বিদেশে পাঠালে ওর যা স্বভাব তাতে সেখানে ও টিকতে পারবে না। টাকাগুলো নষ্ট করে খালি হাতে ফিরে আসবে। আর এদিকে সূর্যের উজ্জল ভবিষ্যৎ অঙ্কুরে বিনষ্ট হবে।
একটু থামল অমর। একটা অসহায়ত্বের ভাব ওর মুখের উপর স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
-সমাজে বাস করতে হলে তার অনুশাসন মেনেই চলতে হবে। অমরের বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।
সামাজিক বাধ্যবাধকতা আর অন্তরাত্মার চাপে পিষ্ট হয়ে ওরা দু’জনে অসহায় হয়ে রইল।
একদিকে সমাজের মানুষ আর আত্মীয় স্বজনরা বলছে রবিকে বিদেশে না পাঠালে ও হয়তো চরম কিছু করে ফেলবে আর ওকে চিরদিনের মত হারাতে হবে। সে কথা বিশ্বাস করার মত যথেষ্ট কারণও আছে। রবি চিরিদিন খুব জেদি আর আবেগপ্রবন ছেলে, অধিকন্ত, ওর মামা চাচা আর সমাজের মানুষ ওর অধিকার থাকা সত্ত্বেও ওকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে অবিরাম মন্ত্রণা দিয়েই চলেছে। ও যদি চরম কিছু করেই বসে তাহলে সমাজ অমরকে বিভিন্ন ভাবে দোষারোপ করে বিচারের কাঠগড়াই দাড় করাবে।
অন্য দিকে সূর্য যার অধিকারের দাবির পিছনে সামাজিক স্বীকৃতি নেই, বঞ্চিত হওয়ার বেদনা থেকে ও কিছু করে বসলেও তাকে হারানোর ব্যাপারে সমাজের কারও কোন দায়বদ্ধতা থাকবে না।
-জান অধরা, যেখানে হারানোর ভয় থাকে সেটা প্রকৃত ভালবাসা নয়, প্রকৃত ভালবাসা কখনো হারায় না, কারণ তার স্থান হৃদয়ে। রবি তোমার ঔরসে জন্ম সেটা সামাজিক ভাবে স্বীকৃত সত্য তায় ওকে হারানোর যে ভয়ের কথা সমাজ বলছে সেটা প্রকৃত ভালবাসা নয় বরং মায়া বা আমিত্ব বলা যায়। অন্যদিকে সমাজের চোখে সূর্যকে হারানোর ভয় নেই কারন ও তোমার ঔরসজাত নয়, ওর কোন সামাজিক স্বীকৃতি নেই। ওকে হারালে সমাজের চোখে কিচ্ছু আসবে যাবে না, কিন্তু রবির মত ওর স্থানও আমাদের অন্তর জুড়ে। সেখান থেকে আমাদের সন্তানেরা কেউ কখনো হারাবে না। এটাই প্রকৃত ভালবাসা, যা পুরোটাই একতরফা, সেখানে হারানোর ভয় নেই আর তা যে কোন সামাজিক বাধ্যবাধকতার অনেক ঊর্ধ্বে।
সেদিন সারা রাত ওরা স্বামী স্ত্রী আলোচনা করে কোন কুল কিনারা করতে পারল না। কেউ চোখের পাতা বন্দ করতে পারল না।
কষ্টের রাতও ভোর হয়। তেমনি ভাবে প্রকৃতির নিয়মে ওদের নির্ঘুম রাতের আঁধার ভেদ করে ঝলমল করা সূর্য উঁকি দিল।
খুব ভোরে দরজায় কড়া নাড়া শব্দে ওরা দরজা খুলল। হাসি মুখে সূর্য দাড়িয়ে। শহর থেকে খুব ভোরে এসে নেমেছে।
-বাবা, ব্যাপারটা তোমাদেরকে আগে জানায়নি, আমি বিদেশের একটা ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম, ওরা আমার রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে ফুল স্কলারশিপ মঞ্জুর করেছে। ওরা যে টাকা দেবে তা দিয়ে পড়াশোনা আর যাবতীয় খরচ চালিয়েও উদ্বৃত্ত থাকবে। ভাল ফল করতে পারলে আমি ওখানেই চাকরি পাব, আর তোমাদেরকে নিয়ে যাব আমার কাছে।
ছেলের কথা শুনে বাবা মা দু’জনই হতবাক হয়ে রইল। ওদের দু’চোখ বয়ে আনন্দাশ্রুর বন্যা বাঁধ ভাঙল।