জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১১।

আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২২, ১১:৫২

অম্বরাবনী-১১ 

 

দীর্ঘ গৃহ যুদ্ধ থেকে সবে মাত্র বের হয়ে আসা যুদ্ধবিদ্ধস্ত মোজাম্বিকের মানুষ ভীষন দরিদ্র। ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে দীর্ঘদিন নিপীড়িত হতে হতে সাধারণ মানুষের যেন কেবল খেয়ে বেচে থাকায় একমাত্র প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে।
এধরণের বেশ কিছু ও দেশের কালো চামড়ার মানুষ অবনীর অধীনে কাজ করে।
নৈতিকতা নামক শব্দটা যেন ওরা আপাততঃ ওরা ওদের অভিধান থেকে বাদ দিয়েছে। তায় ওদেরকে নিয়ে সব সময়ই সতর্ক থাকতে হয়।
জাতিসংজ্ঞের অধীনে এখানে অনেক দেশের সেনাবাহিনী কাজ করছে তাদের সব খাবার দাবার সহ যাবতীয় সবকিছুই অবনীর ষ্টোর থেকেই সরবরাহ করা হয়। দ্রব্যসামগ্রীর মান খুব কঠোর ভাবে নিয়ত্রন করা হয়। তায় বিশেষ করে কোন ফ্রেস খাবার জাতীয় দ্রবাদি একটু রং নষ্ট হলে বা টিনজাত খাবারের তারিখ কোন ভাবে একদিনও উর্ত্তীর্ণ হলে সেগুলো ফেলে দেয়া হয়।
ফেলে দেয়া খাবার গুলো কুড়িয়ে সেগুলো খেয়ে আর অল্পদামে বাজারে বিক্রি করে বেশ কিছু মানুষ তাদের জীবন বাচিয়ে রাখে।
একদিন সকালে একজন ষ্টোর অফিসার ওকে জানালো যে ষ্টোরে কর্মরত এদেশের কিছু কর্মচারী ইচ্ছা করে ফল বা তাজা খাবার গুলো অবহেলা করে নষ্ট করছে। আর ইচ্ছাপূর্বক খাদ্যসামগ্রীর ডেট ওভার করার জন্য বিশাল ষ্টোরে রক্ষিত আগের মাল গুলো বাদ রেখে পরে আনা মাল কৌশলে ইস্যু করাচ্ছে, যাতে ডেট ওভার হওয়া মালামালগুলো ফেলে দিতে হয়।
তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। তদন্তে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেল, আর তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এর বিহিত করার পদক্ষেপ গ্রহন করলো অবনী।
প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ওদেরকে কাজ থেকে বিদায় করার চিন্তা করা হলো। কিন্তু যেহেতু এ অঞ্চলের প্রায় সবাই ঐ ফেলে দেয়া খাবার কুড়িয়ে বা অল্প পয়সায় বাজার থেকে কিনে জীবন বাচায় তায় ওদের জায়গায় অন্য যাকেই নেয়া হোক সেও অবধারিত ভাবে ঐ একই কাজ করবে বলে সবাই মত প্রকাশ করলো।
যাহোক শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো যে তত্তাবধায়ক অফিসার আরো বেশী করে ওদের কাজ তদারকি করবে। আর রিজেক্ট হওয়া সব খাদ্যদ্রব্য প্রতিদিন বাইরে স্তুপ করে বিকালে ষ্টোর বন্দ করার সময় অফিসারের উপস্থিতিতে বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে মাটি চাপা দেয়া হবে।
এ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর রিজেক্ট হওয়ার মত খাদ্যদ্রব্যের পরিমান আপততঃ কমলো বলে মনে হলো। তবে সমস্যা হলো অন্যখানে।
দিনের শেষে ঘড়ঘড় শব্দ করে আসা বুলডোজারের পিছন পিছন ভাবলেসহীন শুখনো মুখের অনেক সংখ্যক ক্ষুধার্ত মানুষ আসতে শুরূ করলো।
বুলডোজারটা ঢোকার জন্য গেট খুললেই সেই ফাঁক দিয়ে মাছির মত মানুষগুলোও ঢুকে যায়। অন্য কোন দিকেই ওদের খেয়াল নেই। কারণ দিনের শেষে হাতে সময় ওদের খুবই কম। পরিত্যক্ত খাবারগুলো বুলডোজারের সামনে সাজিয়ে রেখে সরে যাওয়া আর ওগুলোকে মাড়িয়ে দেয়ার জন্য বুলডোজারটা ঐ পর্যন্ত যাওয়া পর্যন্ত সময়টুকু। এর মধ্যেই যা কিছু নেয়া যায় তায় বা কম কি।
যাহোক অবনীর নেয়া ব্যবস্থানুযায়ী সব ঠিক ঠাক ভাবে চলতে লাগলো। ওর অফিসার বেশ কিছু দিন আর কোন কমপ্লেন করে না।
কিন্তু কমপ্লেনটা করলো একদিন বিকেল বেলা।
এখানে বৃষ্টি কমই হয়। কিন্তু সেদিন দুপুর থেকেই একদম মুসলধারে বৃষ্টি শুরূ হলো। একদম দেশের মত। আকাশে মেঘের গুরূগুরূ গর্জন সেই সাথে দমকা হাওয়া।
উয়িক এন্ড, অবনী প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ক্লাবে যাবে বলে।
প্রথম প্রথম ক্লাবে যাওয়া পছন্দ না করলেও কিছুদিন ধরে এক রকম নিজের উপর জোর খাটিয়েই অভ্যাসটা রপ্ত করেছে অবনী। পুরো সপ্তাহ কাজের শেষে আজকাল ও অন্যান্যদের মত ক্লাবে যাওয়ার জন্য হাফিয়ে ওঠে।
যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতেই আকাশটা আরো কালো মেঘে ছেয়ে ঝম ঝম করে বৃষ্টি আর সেই সাথে ঝড়ের ঝাপটা শুরূ হলো। বিরক্তিতে মনটা বিষিয়ে উঠলো অবনীর। উয়িক এন্ডটা মাটি হওয়ার আশঙ্কায় ও অস্বস্থি বোধ করতে লাগলো।
এটা বোধহয় মানুষ মাত্রেরই একটা দুর্বল দিক। একঘেয়েমি কষ্ট ইত্যাদি থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য অথবা একটু ভালো লাগার জন্য মানুষ কিছু কিছু অভ্যাসকে রপ্ত করে। কিন্তু পরবর্তিতে ধীরে ধীরে সে যখন ঐ অভ্যাসের দাস হয়ে যায় তখন অভ্যাসগুলো সময়ে অসময়ে তার উপর একচ্ছত্র রাজত্ব করতে থাকে। ইদানিং ক্লাবে যাওয়াটা তেমনি একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অবনীর।
আশা ছাড়লো না অবনী। একদম প্রস্তুত হয়ে জানালাটার ধারে বসলো। যেন ঝড় বৃষ্টি থামার পর একটা মুহুর্ত আর নষ্ট না হয়।
কিন্তু একি ঝড়বৃষ্টি যেন থামার নয়। বিরক্ত বোধ করতে করতে ও বোধহয় ক্লান্ত হয়ে একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলো।
মুসলধারে বৃষ্টি ওকে আত্মবিসৃত করে এতদিন জোর করে বন্দ রাখা স্মৃতির জানালা গুলো খুলে দিল।
এক এক করে মনে পড়তে লাগলো কত সব কিছুর কথা। বর্ষা ভেজা মাটির পরিচিত গন্ধটা ওর নাকে এসে লাগছে। আহ কি মাদকীয়!
অবনী তখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী করে। বেশীদিন হয়নি চাকরীটা শুরূ করেছে। দরিদ্রতা মোচনের একটা প্রজেক্টের জন্য বেশ কিছুদিন যাবত ও বস্তিতে ঘুরে ঘুরে ছিন্নমূল মানুষদের নাম লিষ্ট করার কাজে ব্যস্ত।
সেদিনও আকাশটাতে অনেক মেঘ করেছিলো। ওর পরিকল্পনা ছিল ঐ দিনই হাতের কাজটা শেষ করবে। কিন্তু না, বাদ সাধলো বৃষ্টি ঠিক আজকের মত।
টিপ টিপ করতে করতে মুসলধারে বৃষ্টি শুরূ হলো। হাতের কাজ ফেলে তাড়াতাড়ি করে ঐ বস্তিবাসী এক রিকশাওয়ালাকে ডেকে ওর রিকশায় চেপে বসলো অবনী। রিকশাওয়ালা গায়ে পলিথিনের কাপড় পেচিয়ে আর মাথায় একটা টোকা দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই রিকশা চালাতে শুরূ করলো।

অফিসে ফিরবো। তা প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। অর্ধেক পথ আসতেই শুরূ হলো ঝড়ের ঝাপটা। মনে হচ্ছিলো আমাদেরকে সহ রিকশাটা উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
রিকশাওয়ালাকে রাস্তার এক পাশে তাড়াতাড়ি থামতে বললাম। ও রাস্তার পাশের দেয়াল ঘেরা একটা বাসার বিশাল গেটটার বন্দ দরজা ঘেঁসে দাড়ালো। তাতে বাতাসের ঝাপটাও একটু কম লাগতে লাগলো আর গেটের উপর যে একটু ছাউনী আছে তার জন্য বৃষ্টির হাত থেকেও কম বেশী রেহায় পাওয়া গেল।
ঠিক তখনই একটা প্রাইভেট কার এসে ভিতরে ঢোকার জন্য ব্যস্ত ভাবে হর্ণ দিতে শুরূ করলো। রিকশাওয়ালা রিকশাটা গেটের সামনে থেকে সরাতে সরাতে ভিতর থেকে দারোয়ান গেটটা খুলে দিতেই গাড়ীটা ভিতরে প্রবেশ করলো। পিছন থেকে যা দেখা গেল তাতে পিছনের ছিটে কোন একজন বসা আছেন মনে হলো।
গেটটা খোলা। কিছুক্ষন বাদে দারোয়ান গলা উচিয়ে রিকশাওয়ালাকে গেটের ভিতরে রিকশা নিয়ে ঢুকার জন্য ডাকলো।
ভাবলাম অবস্থা দেখে দারোয়ানের বোধহয় একটু দয়া হয়েছে।
পুরোনো আমলের সামনে উচু বারান্দা ওয়ালা বিশাল বাড়ী। সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা।
রিকশাটা ভিতরে প্রবেশ করে বারান্দা ঘেসে দাড়াতেই আমি তাড়াতাড়ি নেমে বারান্দায় উঠে দাড়ালাম। রিকশাওয়ালাও আমার সাথে রারান্দায় উঠে এল।
আমার হাটু থেকে নিচের অংশটা ভেজা, গা মাথা কোন রকমে বাচিয়েছি। আর রিকশাওয়ালার মাথাটা বাদে বাকিটা প্রায় ভেজা।
বারান্দার একপাশে দাড়িয়ে ও ওর লুঙ্গি জামা চিপে নিচ্ছে। ততোক্ষনে আমি রূমালটা বের করে হাত মুখটা মুছে টাই জামা ইত্যাদি ঠিক করে নিয়েছি।
গাড়ীর ড্রাইভারটা বাড়ীর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলো। বোধহয় ওর সাথে গাড়ীতে যিনি ছিলেন তাকে ভিতরে রেখে আসলো।
আমার দিকে দেখলো একটু। তারপর মৃদু হেসে বললো - ভিজে গিয়েছেন দেখছি। যান ড্রইং রূমে একটু বসুন। যা মনে হচ্ছে বৃষ্টি থামতে বোধহয় সময় লাগবে।
আমি রিকশাওয়ালার দিকে তাকালাম। ও আমার জন্যই ভিজেছে। আজ এই খারাপ আবহাওয়াই অন্যান্যদের মত ও না আসলেওতো পারতো। তাতে হয়তো রেইন কোর্ট পরে বোকার মত দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমাকে হয়তো ভিজতে হতো কিন্তু বেচারারতো এ দশা হতো না।
এ বাড়ীতে ওতো আমার সাথেই এসেছে। ভাবছি এরা যদি আমার পরিচিত কেউ হতো তবে ওর জন্য গুখনো কিছু কাপড়ের ব্যবস্থা করতাম।
-ভাবছি ড্রাইভারকে কিছু বলবো নাকি!
ড্রাইভার বোধহয় বুঝলো আমার কথা।
-আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি ভেতরে ড্রইং রূমে যেয়ে বসুন।
ও আর রিকশাওয়ালা দৌড় দিয়ে চলে গেল। উকি দিয়ে দেখলাম লনটার এক কোনে খোলা গ্যারেজ আর উপর দোতলা একটা ঘর। নিশ্চয় ড্রাইভারের ঘর ওটা।
বেশ বড় ড্রইং রূমটা। ঢুকতেই একজন বৃদ্ধ কাজের লোক এসে বললো -স্যারের শরীরটা খারাপ, ডাক্তার দেখিয়ে মাত্র ফিরলেন। গেষ্ট রূমের বাথরূমে তোয়ালে আছে আপনি গা মাথা মুছে নিন।
আমি বাথ রূম থেকে বেরিয়ে দেখি কাজের লোকটা একটা ট্রেতে করে আনা চা বিস্কুট টেবিলে রাখছে।
-আপনি চা খান।
চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বৃদ্ধ পুনরায় বললো -বাড়ীতে কেউ নেই। আমি পাশের রূমে আছি, দরকার হলে ডাকবেন।
আমি বসলাম। খোলা দরজা দিয়ে লনটা দেখা যাচ্ছে। খোলা গ্যরেজের মধ্যে একটা টুলে রিকশাওয়ালা বসে চা খাচ্ছে। মনে হলো গামছা নিংড়িয়ে গা মাথা মুছে নিয়েছে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাড়ীওয়ালাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমার জন্য এতকিছু না করলেও তো পারতো। সত্যি কথা বলতে কি, রিকশাওয়ালার জন্য খারাপ লাগলো। ভাবলাম আজ আমার বিপদে পড়ার জন্য কোনক্রমেই এই বাড়ীর মালিক দায়ী নয় তবুও আমার জন্য তিনি এতটা করছেন। অথচ আমার কারণেই দরীদ্র রিকশাওয়ালার এহেন দশা হওয়ার পরও ওর জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না। আর আতিথেয়তার দরকার আমার থেকে ওর বেশী।
নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হলো।
ঝড়বৃষ্টি থামলো প্রায় ঘণ্টা খানেক পর। ততোক্ষনে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বাড়ীর লোকজনের কাছে ওর মালিকের ভূয়সী প্রশংসা করে রিকশায় চড়ে রওয়ানা হলাম।
মনে মনে ভাবছি বাড়ীওয়ালার মহানুভবতার কথা।
-স্যার, ও বাড়ীর ড্রইভারটা খুব ভালা মানুষ, আমার বসার জন্য অত দামী গাড়ীটা গ্যারেজে উঠালো না। আর আমাকে ঠান্ডার মধ্যে গরম চা খাওয়ালো। খুব বড় মনের মানুষ হ্যারা।
বুঝলাম ওটুকু আতিথেয়তায় সেও আমার মত খুব খুশী।
ভাবলাম বিধাতা প্রকৃতই মহাপরাক্রমনশালী। মানুষের নিজের সংগতি অনুযায়ীই মনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। অত সাজানো গোছানো ড্রইং রূমের আতিথেয়তায় আমি যতটুকু তৃপ্তি পেয়েছি, চপ চপে ভিজা কাপড়ে গাড়ীর গ্যারেজে বসে এক কাপ গরম চা খেয়ে ঐ দরীদ্র অশিক্ষিত রিকশাওয়ালার তৃপ্তির পরিমাণ তার চেয়ে কোন অংশে কম না।
সেদিন অবনীর মনে একটা বিশ্বাস জন্মালো। বিধাতার এ প্রথিবীতে সব কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। মানুষের বাথ্যা বেদনা তৃপ্তি অতৃপ্তির পরিমাণও সমান; ঠিক যেমন খোলা গ্যারেজে টুলে বসে ভেজা কাপড়ে এক কাপ গরম চা ওকে যেমন তৃপ্তি দিল তা শুখনো কাপড়ে আরামদায়ক রুমে বসে এক কাপ গরম কফি খেয়ে আমার অনুভূত যে তৃপ্তির থেকে কোন ভাবেই কম না। সব কিছুই মেনে নিয়ে মনে নিলেই উদ্ভূত অনুভবগুলো সকলের জন্যই সমান্তরল হয়ে যাই।
তায় চিন্তার কোন কারণ নেই, সমস্যাও নেই। শুধু নিজের কর্তব্যটুকু ঠিক মত করলেই হলো।


Read More