জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১৯।

আপডেট: ৩০ জানুয়ারী ২০২৩, ১১:৫৩

অম্বরাবনী-১৯ 

 

ইতিপূর্বে প্রায় বছর দুই ডালবেহারার সাথে অবনী খুব অন্তরঙ্গভাবে কাজ করেছে। তখনই ওরা একে অপরকে গভীর ভাবে কাছ থেকে দেখেছে। সারা দিনের কাজের শেষে ওরা ডিনারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কথা বলতো তখন।
ডালবেহারা মাঝে মধ্যে খুব বেশী ড্রিংক করতো। মানুষে মানুষে হানাহানির কথা বলতে বলতে সব সময়ই ওর চোখ দুটোতে অশ্রু টলমল করতো।
ডালবেহারা প্রায়ই বলতো -জানো অবনী এরা একে অন্যকে খুন করছে শুধু মাত্র তার একটাই কারণ; এরা একে অন্যের থেকে পৃথক। ওদের একমাত্র দোষ ওরা জন্ম সুত্রে যা তার জন্য।
আমি জন্ম সুত্রে যা তা যদি দোষের কিছু হয় তার জন্য যে কেউ দায়ী হোক না কেন আমাকেতো কোনক্রমেই দায়ী করা যায় না।

প্রায় সারা রাত অবনী ভাবলো ডালবেহারাকে নিয়ে।
একবার মনে হলো –ওহ, কালকের ইণ্টারভিউয়ের ব্যপারে কিছু আলাপ করার দরকার ছিল।
যাহোক পরদিন সকাল দশটায় ইণ্টারভিউ। অবনী একটু আগেভাগেই পৌছালো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। উদ্দেশ্য ইণ্টারভিউয়ের আগে ডালবেহারার সাথে একটু দেখা করা।
কিন্তু ওর অফিসে যেয়ে জানলো সে এক মাসের ছুটি নিয়েছে।
একটু অবাকই হলো অবনী। গত রাতে এত কিছু আলাপ হলো কিন্তু ছুটি যাবে সে কথাতো একবারের জন্যও বললো না।
বাকি সময়টুকু বসলো ওর অফিসে। ওর সেক্রেটারী পচিশ থেকে ত্রিশের মত বয়স, পোলান্ডের বাসিন্দা। কথায় কথায় বললো ডালবেহারা লিভার ক্যানসারে ভুগছে অবস্থা খুব একটা ভালো না।
কথাটা শুনে স্তম্বিত হয়ে রইল অবনী। ওর হাত পা যেন অবস হয়ে আসতে লাগলো। ভাবল –হায়, গত রাতে জীবন আর জীবিকার কথা বলতে বলতে শরীরের কথাটা একদম বাদ পড়েই রইলো।
মনটা একেবারে শুন্য মরূভূমির মত খা খা করতে লাগলো ওর।
ডালবেহারার সেক্রেটারীর মনে করিয়ে দেয়ার বদৌলতেই সময় মত অবনী হাজির হলো ইণ্টারভিউয়ের জন্য।

অবনী বাদে আরও চারজনকে ডাকা হয়েছে ইন্টারভিউতে।
দশটার সময় অবনী ইন্টারভিউ বোর্ডের রুমে প্রবেশ করলো।
প্রাথমিক আনুষ্ঠানিক ভদ্রতা বিনিময়ের পর অবনী বসলো।
ছয় জন বসা ইন্টারভিউ বোর্ডে।
এক এক করে সবাই বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন। সব প্রশ্নের জবাব অবনী ওর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে দিল। অবনীর বিভিন্ন মিশনের অভিজ্ঞতার ব্যপারে আলোচনা হলো। বিশেষ করে মোজামবিক মিশানের সফলতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হলো।
সকলেই ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং নতুন মিশানের জন্য তার ঐ সব অভিজ্ঞতা বিশেষ কাজে আসবে বলে মন্তব্যও করলেন।
অবনী বেশ আস্বস্থ বোধ করছিল। নতুন এসাইনমেণ্টের জন্য ও নিযুক্তি পাবে কি পাবে না সে বিষয়ের থেকে ওর কাজের এবং যোগ্যতার স্বীকৃতির জন্য অবনী মনে মনে সুখ অনুভব করলো।
ইণ্টারভিউ বোর্ডের ষষ্ঠ ব্যক্তি যিনি এতক্ষন ধরে মোটামুটি চুপচাপ ফাইলে মুখ গুজে বসেছিলেন তিনি হটাৎ করেই সরব হয়ে উঠলেন।
তিনি ফাইলের থেকে মুখ না উঠিয়ে একটু গম্ভীর গলায় মন্তব্য করলেন- অন্যান্য সকল যোগ্যতার পাশাপাশি এমন একটা কাজে সততার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। যে উচ্চতর এসাইনমেণ্টের জন্য আপনাকে ডাকা হয়েছে তার জন্য একজনের জীবনের যাবতীয় দিক খতিয়ে দেখা দরকার।
একটু থেমে তিনি জানতে চায়লেন অবনী ইউএনএ যোগদান করার পূর্বে কোন মাল্টিন্যশনাল কোম্পানীতে চাকুরী করতো কিনা।

অতীতকে চিরদিনই একটু ভয় পায় অবনী। কারণ ওটা অন্ধকারে ভরা। তায় প্রশ্নটার উদ্দেশ্য না বুঝলেও ওর বুকটা একটু কেপে উঠলো কোন এক অজানা কারণে।
অবনী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো প্রশ্নকারীর দিকে। আর বোর্ডের অন্য সবার উৎসুক অবাক দৃষ্টি ওর দিকে।
-দেখুন, যে একটা এসাইনমেণ্টের জন্য আপনাকে এখানে ডাকা হয়েছে সেখানে মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এসবের সাথে সততার প্রয়োজন কোন ক্রমেই কম নয়।
ফাইলের পাতা থেকে মুখ না উঠিয়েই কথাগুলো বললেন বোর্ডের ষষ্ঠ প্রশ্নকারী।
অবনী তেমনি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ও ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না যে আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে সততাহানীকর কি কাজ সে করেছে যে এতদিন বাদে যার রেশ তাকে বহন করতে হবে।
নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে স্মৃতির পাতা ওলটাতে লাগলো অবনী। ওর কোন কাজটা সততা হানীকর!

অবনীর মনে পড়লো ওর পারসোনাল এ্যসিসট্যাণ্ট মানে পিএ হিসাবে চাকুরী করতো মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক। নাম ছিল আরনা। ওর বাবার দশ সন্তানের মধ্যে ও ছিল নয় নম্বর। বাবা নাকি অধিক সন্তানের জন্য বিতৃষ্ণা হয়ে বিধাতার কাছে ক্ষমা প্রাথনা করে ওর ওই নামটা রেখেছিল।
দিন আনা দিন খাওয়া বাবার নয় নম্বর সন্তান হয়ে খাওয়া না খাওয়া অবস্থায় মানুষ আরনা। জীবনের কাছ থেকে ওর চাহিদা ছিল খুবই কম, অল্পতেই সন্তুষ্ট। বিধাতার দেয়া জীবনটা কোন রকমে বাচিয়ে রাখাই যেন জীবনের লক্ষ্য।
আরনা নিজেও বেশ কয়েক জন সন্তানের জনক। পুরো সংসারটায় ওর ওই চাকরীর আয়ের উপর নির্ভরশীল। তবে অন্য সকলের মত সংসারটা স্বচ্ছল করার চিন্তায় অন্য দশ জনের মত ছোট বয়সে ছেলে মেয়েদের কাজে না লাগিয়ে অবৈতনিক সরকারী স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। আশা ছিল- রাস্তা ঘাটে রোদে পুড়ে আর জলে না ভিজে একটু লেখাপড়া জানলে অন্ততঃ কোন অফিসে দাড়িয়ে বসে কাজ করতে পারবে।
-যার কপালে যা আছে তায় হবে, আমার চেষ্টা আমি করে যাব। এ ধরনের মন্তব্য করেই আরনা ওর ছেলেমেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মনকে শান্তনা দিত।
আরনাকে নিয়ে মাঝে মধ্যে বেশ হাসি তামাসাও হত। প্রথমতঃ ওর নামটা নিয়ে আর দ্বিতীয়তঃ ওর ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যতে কাকে কি বানাবে সে ব্যপারে ওর পরিকল্পনা নিয়ে।
এ ধরনের আলোচনায় আরনা সবসময়ই আন্তরিক। কোন রকম ঘোর প্যচের আশ্রয় নিত না কোন সময়। ওর ইচ্ছে যত কষ্টই হোকনা কেন তিনটে ছেলে আর একটা মেয়েকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াবেই।
ওকে এ পৃথিবীতে আসাটা বন্দ করার জন্য বাবা মা যেখানে অসহায়ের মত কেবলমাত্র বিধাতার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করাকেই বেছে নিয়েছিলেন। সেখানে ওর নিজের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য আরনা এর থেকে আর বেশী কি করবে!
আরনা ছোট বয়েসে ওর দূর সম্পর্কীয় এক চাচার বাসায় কাজ করত। ওদের ছেলেমেয়েদের পাশ করা ক্লাসের পরিত্যক্ত বই নিয়ে কি ভাবে লেখাপড়া শিখেছে সে কথা বলতে বলতে ওর চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠত।
ওর ইচ্ছা ওর ছেলেগুলোর একজনকে কম্পাউন্ডার, একজনকে ড্রাইভার আর একজনকে ইউনিয়ন বোর্ডের চাপরাশি বানাবে।
হিসাবটা এরকম; রোগ সোগ তো লেগেই থাকে তায় কম্পাউন্ডার ছেলে থাকলে অসুখ বিসুখে আর চিন্তা করতে হবে না। একটা ছেলেকে কোন বড় সাহেবের গাড়ীর ড্রাইভার বানাতে পারলে যে কোন জরূরী দরকারেতো কাজে লাগবেই তাছাড়া সুযোগ বুঝে গাড়ীতে করে একটু ঘুরেও আসা যাবে। আর একটা ছেলে চেয়ারম্যান সাহেবের চাপরাসি হলে সব সময় গ্রামের সবাই ওকে একটু মান্য গন্যও করবে।
ছেলেদের নিয়ে ওর অভিনব সব পরিকল্পনা আমাদের জন্য হাসির খুব খোরাক হতো। ওর ছেলেদের সম্বন্ধে পরিকল্পনা শুনে অবনী একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল -আর মেয়েটাকে একটা পুলিশের সাথে বিয়ে দিয়ে দিও তাহলে সিকিউরিটির আর কোন সমস্যা হবে না।
আরনা সে হাসি ঠাট্টাটা আন্তরিক ভাবে গ্রহন করে বলেছিল -স্যার মেয়েটা দেখতে খারাপ না, মাথায় ঘন কালো চুল আর এই বয়সেই রান্না সহ ঘরের সব কাজকর্ম শিখে ফেলেছে। পুলিশের ঘরে ওকে মানাবে।
কাজে কর্মে খুবই আন্তরিক আরনা। ফাঁকি কথাটা বোধহয় ওর অভিধানে ছিল না। প্রায় বিশ বছর ধরে কোম্পানীতে কাজ করে আর কাজে খুব পারদর্শী এবং বিশ্বাসী ছিল ও।

অফিস গুরূ হত সকাল দশটায়। কিন্তু আরনা অনেক আগেই চলে আসে। প্রতিদিন অফিস খুলে ঝাড়া মোছা ওই করে। তারপর সব চিঠিপত্র খুলে ওগুলোতে সিল মেরে ওর মন্তব্য লিখে দশটার আগেই অবনীর টেবিলে রাখে।
মিশেল সংস্থার রিজিয়নাল ম্যানেজার, তিনিও প্রতিদিন সকালে দশটার আগেই অফিসে চলে আসে। অফিসে বসার আগে তিনি পুরো অফিস কমপ্লেক্সটা ঘুরে দেখেন। কার্য্যরত যাদেরকে পায় সবার সাথেই কুশল বিনিময় করেন। সবাইকে নামে নামে চেনে মিশেল।
আরনার সাথে অবধারিত ভাবে প্রতিদিন সকালে দেখা হয় মিশেলের। দেখা হলে দুএকটা কথার ফাকে ওর ছেলে মেয়েদের নাম ধরে খোজ খবর নেয়।
মিশেল খুব পছন্দ করে আরনাকে।
আরনা প্রথম থেকেই অবনীর সাথে, প্রায় দুবছর হলো ওর সাথে কাজ করে। অবনী খুব পছন্দ করে ওকে।
সেদিন সকালে গাড়ী থেকে নামতেই অবনী দেখলো আরনা দাড়িয়ে গাড়ী বারান্দায়। ওকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। নামতেই আরনা জানালো মিশেল তার অফিসে অবনীকে ডেকে পাঠিয়েছে খুব জরূরী ভাবে। ও উদ্বিগ্ন অবনীর কোন সমস্যা হলো কিনা সেটা ভেবে।
অবনী অফিসে না ঢুকেই সোজা মিশেলের অফিসে গেল।
মিশেল তার অফিসের মধ্যে পায়চারী করছিলো। বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল তাকে।
ঢুকতেই খামে ভরা একটা চিঠি অবনীর হাতে দিয়ে বললো -এর মধ্যে হাতে লেখা একটা এপ্লিকেশান আছে। বিষয়টি তদন্ত করে একটা রিপোর্ট যেন অতি সত্বর ওকে দেয়া হয়।
অবনী একটু চিন্তিতই হয়ে পড়লো। অফিসে এসে খাম থেকে এপ্লিকেশানটা বের করে পড়ে শেষ করতে করতেই আরনা ছুটে আসলো।
-স্যার, সাহেব এত জরূরী তলব করলো, আপনার কোন সমস্যা হয়নিতো।
ওকে বিষন্ন দেখাচ্ছে, ওর নিজের চিন্তায় নয়, অবনীর কোন ক্ষতির আশঙ্কায়।
-হায় বিধাতা! গুপ্ত শত্রু এত কাছ থেকে ওর বুকে তাক করেছে গুলিটা ছুড়বে বলে, ওর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়েও সে সম্পর্কে কিছু না জানার ফলে ও এত নিশ্চিত। শত্রু ওর ঘরে তা সত্ত্বেও ও একটুও বুঝতে পারছে না!
-আরনার মত ছা পোষা মানুষ কার স্বার্থে এত আঘাত দিয়েছে যে ওর গুপ্ত শত্রু ওর নিষ্পাপ পরিবারটাকে এমনভাবে ধ্বংসের নেশায় মেতে উঠেছে!
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল অবনী।
লুকিয়ে থাকা বিষধর সাপ সব সময় অলক্ষে ছোবল মেরে থাকে। সেটাই ওদের চরিত্র। সে ক্ষেত্রেও সাপের সম্ভাব্য আস্তানা সম্পর্কে ধারণা করে তার অবস্থান সম্পর্কে আঁচ করে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে। তায়তো দুনিয়া জুড়ে এত বিষধর থাকা সত্ত্বেও মানুষ নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারে। কিন্তু মানুষ যদি বিষধর সাপের রূপ নেয় তবে তার ছোবল থেকে অসহায় মানুষ কিভাবে বাচবে!
আরনার অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো অবনীর বুক কাপিয়ে।