জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -১১।

আপডেট: ২৩ Jul ২০২৩, ০৯:২৮

জীবনের অন্যপিঠ- ১১ 

 

সাধারণতঃ বিকেল বেলাটায় নীলিমা চৌধুরী হাটা হাটি করেন। কেউ না কেউ সাথে থাকে, কালেভদ্রে কাউকে না পেলে একাকীই হাটেন। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়মিত অন্ততঃ একঘন্টা হাটতে হয় তাকে।
বলা চলে কোনদিন আবহাওয়া খুব খারাপ না হলে বিকালে চৌধুরী এষ্টেটের সবুজের মধ্যে তিনি হাটতে। এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলা চলে। হাটার ফাকে সঙ্গীদের সাথে নানা কথা বলে, নানা ব্যপারে ভাবনা বিনিময় করে নিজেকে হালকা করেন।
সেদিন শীতের বিকেলে নীলিমা চৌধুরী, অমর, অনিরদ্ধ আর লাবনীকে নিয়ে চৌধুরী এষ্টেটের মধ্যে হাটছিলেন।
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পৌছানো ভিন্ন ভিন্ন পটভূমির এ কয়টি প্রাণ। কিন্তু তাদের কথাবার্তায় পরিষ্কার ভাবে প্রতিভাত যে এরা সকলে এই চৌধুরী এষ্টেটের বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে নিজেদেরকে নিমজ্জিত করে জীবনের বাকি পথ চলা শেষ করতে চায় এরা সবাই।
বর্তমানে চৌধুরী এষ্টেটে এদের জীবন প্রবাহের গতি অভিন্ন হলেও ইতিপূর্বে মাড়িয়ে আসা পথটুকু অভিন্ন নয়। ইতিমধ্যে একে অন্যের যাপিত জীবন সম্পর্কে কম বেশী জানলেও সেখানে তারা কেউই একত্রে ছিল না আর তাই জীবনের অন্যপিঠ সম্পর্কে একে অপরের ব্যাপারে বলতে গেলে তেমন কিছুই জানে না।
তবে জীবন পরিক্রমায় ফেলে আসা পথটুকু কোন ক্রমেই এই নতুন উদ্যমে সামনে এগোনর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে সে ব্যপারে এরা সবাই সতর্ক এবং যেন এক অবলা চুক্তিতে আবদ্ধ।
বিভিন্ন কর্মব্যস্ততা থেকে আসা এরা সবাই পূর্বে ঘটা সব কিছুকে একটা পরিষ্কার সীমরেখা টেনে সেগুলো পিছনে ফেলে তা থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এখন এরা এই নির্লিপ্ত মূক চৌধুরী এষ্টেটকে সরব করে এখানে নতুন করে শুরূ করে বাকিটা এখানেই শেষ করতে চায়।
এরা সবাই আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছিল বৈষিয়কতার মাপকাঠিতে নিজেকে অনেক উঁচু আসন বসাতে। কিন্তু জীবন চলার এই পর্যায়ে এসে এরা এখন যেন আগের নিজকে ভুলার প্রতিযোগীতায় মেতেছে।
চৌধুরী এষ্টেট এদের সবাইকে নিরাপদ আশ্রয় দান করে এদের সাথে সেও এক অবলা অলিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে।
প্রতিদিন অনেক কথা হয় ওদের মধ্যে, তার অধিকাংশ চৌধুরী এস্টেটের কাজের ব্যাপারে। কখনো হালকা মেজাজের কখনো বা গভীর।

হাসপাতালের সামনে ফাকা জায়গাটা ছেড়ে ওরা বিভিন্ন গাছ গাছালির বনের ভিতর দিয়ে হাটছে। সূর্যের আলো আছে ঠিকই কারণ সে আলোতেই পথ চলছে ওরা কিন্তু এই মুহুর্তে এই নীবিড় অরণ্যে সূর্যের অবস্থান এদের কারোরি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। আর প্রকৃত অর্থে সে দিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই এদের কারোরি। সবাই যেন নিজের মত।
মৃদু মন্দ বাতাস চৌধুরী এষ্টেটের বাগানের সবকটি গাছের শাখাতেই দোলা দিচ্ছে। দিঘীর জলও বাতাসে মৃদু আন্দোলিত হচ্ছে। সরূ পথটার উপর বিছিয়ে থাকা নুড়ি পাথর গুলোও ওদের পদভারে সরব হয়ে উঠেছে। এই সুন্দর অপরাহ্ণে ঝিম ধরে বসে থাকা প্রজাপতিরাও পাখা মেলেছে। সেই সাথে পাখীদের কিচির মিচির শব্দ চৌধুরী এষ্টেটকে জীবন্ত করে তুলেছে।
চৌধুরী এষ্টেটের আপন অতিথী ওরা। আর সে আনন্দেই যেন চৌধুরী এষ্টেট সরব হয়ে উঠেছে।

বনের ভিতরেই একটু দূরে গাছের ফাক ফোকড় দিয়ে দেখা যাচ্ছে সামনে প্রকান্ড একটা দিঘি, চারদিকে উচু পাড়। বড় সান বাধানো ঘাটটা আবছা দেখা যাচ্ছে।
ঘাটে বসা কে একজন মনে হলো হটাৎ উঠে বনের ভিতর মিলিয়ে গেল। বোধহয় ওদের আগমনের শব্দ টের পেয়ে উঠে চলে গেল।
অন্য কেউ খেয়াল না করলেও সেটা নীলিমা চৌধুরীর দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি জানেন রামদয়াল কিছু না করার থাকলে এভাবেই চৌধুরী এষ্টেটের কোণে কোণে ঘুরে বেড়ায়।
ঘাটে বসলো সবাই একটু জিড়িয়ে নেবে বলে।
মৃদু মন্দ বাতাস শান্ত দিঘীর জলকে কিছুটা আন্দোলিত করে এক অপরুপ ছন্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। তারই উপর ভেসে বেড়াচ্ছে শীতের পাখী। অনেক দিন পর এবছর আবার এসেছে ওরা। সে দিকেই তাকিয়ে সবাই।

-তোমাদের সাথে রামদয়ালের পরিচয় হয়েছে?
নীলিমা চৌধুরীর কথায় সবার মনোযোগ আকর্ষিত হলো।
-হ্যে, হয়েছে।
জবাবটা দিল ডাঃ লাবনী।
-প্রকৃত পক্ষে চৌধুরী এষ্টেটে আমার প্রথম দেখা ওরই সাথে।
সবাই তাকালো তার দিকে।
-নতুন অচেনা জায়গা, রাস্তা খারাপ আর আঁকাবাঁকা, ভেবেছিলাম সময় লাগবে। তাই আমার ছেলে সাগর ঘুম থেকে উঠার আগেই চাচার ড্রাইভারকে নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম খুব সকালে। কাজ শেষে যেন বেলা থাকতেই ফেরত আসা যায়।
সবাই মনোযোগ শুনছে লাবনীর কথা।
-কিন্তু পৌছাতে বেশী সময় লাগলো না। অত ভোরে কাউকেই চোখে পড়লো না। এত ভোরে আসাতে একটু বিব্রতই বোধ করছিলাম। একবার ভাবলাম ফিরে যায়, এখানে চাকরী করা বোধহয় সম্ভব হবে না।
সবাই তাকিয়ে লাবনীর দিকে।
-গেটেই দাড়িয়ে ছিল রামদয়াল। মনে হলো ও যেন জানতো আমি আসবো অত সকালে।
-সময়টা না জানলেও আমি যে আসবো সেটা জানতো ও। পরে জানলাম অনিরূদ্ধই বলেছিলো ওকে। তবে সময়ের মিলটা বোধহয় কাকতালীয়।
-ওকে দেখেই কেন জানিনা ভালো লাগলো। হাসি মাখা মুখ।

-আপামনি আসুন, চিনতে কষ্ট হয়নিতো। জায়গাটা প্রথম দেখাতে পছন্দ হয় না কারো।
রামদয়াল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় আমার অপছন্দের কথাটা বুঝতে পেরেছিলো।
-আপামনি, জীবিকার ব্যপারটা আমি বলতে পারবো না, কারণ ওটা অংকের ব্যপার, যে হিসাব বোঝে সেই কেবল মিলাতে পারে। তবে জীবন কাটানোর জন্য সম্পদের অভাব নেই চৌধুরী এষ্টেটে, এটা আমি আপনাকে নিশ্চিত বলতে পারি।
গাড়ীর দরজা খুলতে খুলতে কথাটা বললো রামদয়াল।
-আশে পাশে অন্য কাউকে চোখে পড়লো না। ভাবলাম বোধহয় কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি, উঠলেও বের হয়নি। রামদয়াল আমাকে নিয়ে নিঃসঙ্কোচে এই সব বাগান দিঘী সব ঘুরিয়ে দেখালো।
-শান্ত সকালে মৃদু বাতাসে গাছের পাতা নড়া, পাখীর কিচির মিচির শব্দ, গাছের ডালের ফাক দিয়ে উকি দেয়া সূর্যের কিরণ সব মিলে মনে হলো প্রকৃতি এখানে কথা বলে। চৌধুরী এষ্টেটের এ রূপ সত্যি বলতে আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেললো।

কথা বলার ফাকে হাতে ধরা বোতল থেকে একটু পানি খেয়ে দিল লাবনী।
-সবার কথাই বললো রামদয়াল। চৌধুরী এষ্টেটের সব ইতিহাস ওর জানা। ওর নিজের সম্পর্কে শুধু বললো -এসবের মায়ায় পড়ে আছি। আমার এখানেই শুরূ এখানেই শেষ। বড় মায়াই জড়িয়ে পড়েছি আপামনি।
-দাদা আর বাবার কবরের পাশেই আমির চৌধুরীর কবরটা দেখাতে দেখাতে কান্নায় ওর গলা ধরে এসেছিলো।
-কিছু কিছু মানুষ শুধু এক বুক কষ্ট নিয়ে বিদায় নেয়ার জন্য এ দুনিয়াই আসে। কি যে ইচ্ছে বিধাতার! চৌধুরী বাবা এসবের প্রাণ ছিলেন। তিনি এখনো আছে এখানে কোথাও, এসব কি ভূলে থাকা যায়!
চশমা খুলে চোখ মুছলো রামদয়াল।
-প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে ঘুরে ঘুরে ও আমাকে সব দেখালো, চৌধুরী এষ্টেট সম্পর্কে সংক্ষেপে সবই বললো।
-বাগানের সব গাছ গাছালি দেখানোর সময় একটু ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে রামদয়াল বলেছিলো -আপামনি এই সব বড় বড় নানা জাতের ফল আর দামী কাঠের গাছ দেখছেন এগুলো অতি যত্নে বাছাই করে বিভিন্ন জায়গা থেকে সঙ্কর জাতের চারা এনে লাগানো। খুব জত্ন করে এগুলো লাগানো। দেখেন কি সুন্দর লাইন ধরে সব দাড়িয়ে আছে। এগুলো দেখতেও সুন্দর আর এর মূল্যও বেশী।
একটা চাপা নিঃশ্বাস টানলো রামদয়াল।
-আর ওই যে ছোট খাট শীর্ণ গাছগুলো দেখছেন, ওগুলো আগাছা, সবার অলক্ষে এমনিতেই জন্মায় আবার এমনিতেই মরে যায়। শত চেষ্টা করেও এদেরকে নিধন করা যায় না। এরা দৃষ্টিকটু আর মূল্যহীন। এখানকার মাটিতেই এদের জন্ম। মাটির টানেই যেন পড়ে আছে এরা।
একটু স্মিত হাসলো ও। বুঝলাম সেটা ওর নিজেকে উদ্দেশ্য করে।
-এ বাড়ীর সাথে আমার সম্পর্ক এদের মতোই। চৌধুরী এষ্টেটের প্রেমেই মজে আছি আমি।

একটু থামলো লাবনী। চারিদিকে নিস্তব্দতা। সবায় তন্ময় হয়ে শুনছে।

-মৃদু হাসলো রামদয়াল। কিছুটা রহস্যময় লাগলো ওকে। তারপর নিন্মস্বরে বললো -আপামনি চৌধুরী এষ্টেট কথা বলে, আমাদের মত আবেগ প্রকাশ করে।
-তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
-প্রকৃত অর্থে রামদয়ালের সাথে সাক্ষাতের প্রেক্ষিতেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এখানে অবস্থানের।

চারিদিক নিস্তব্দতায় ভরা, বাতাসও যেন থমকে দাড়িয়ে আছে। একটুও নড়ছে না দিঘীর জল। শীতের পাখীগুলো কেবল নির্বিঘ্নে ভাসছে।
কেউ কোন কথা বললো না।