Heading
আপডেট: ১৪ অগাস্ট ২০২৩, ১১:২৫
ডাঃ লাবনী আর তার স্বামী সাইপ্রাসের অধিবাসী আন্দ্রিয়াস দুজনেই এখন ভেবে আশ্চার্য্য হয় যে ওদের ভালবাসা, বিয়ে হওয়া, সন্তান হওয়া ঐ দিন গুলোতে একটি বারের জন্যও এতবড় একটা বিষয় ওদেরকে একটুও চিন্তিত করেনি।
জীবনের এ পর্যায়ে এসে কোন দেশে বসবাস করবে সে বিষয়টি নিয়ে ওদের মতানৈক্যের জন্য ওরা নিজেকে বা অন্য কাউকেই দায়ী করে না।
আলাদা দেশে বসবাস করলেও একে অপররের প্রতি ওদের ভালবাসা আগের মতোই অটুট।
নীলিমা চৌধুরী, অমর, অনিরূদ্ধ সবার সাথে পরিচিত হয়ে লাবনীর বাবা, ভূতপূর্ব এ্যাম্ব্যাসেডর, মাহতাব খান খুব খুশী হলেন। এ বাড়ীর সকলের সম্পর্কে লাবনীর প্রতিটি তথ্যই সত্য দেখে খুব আশ্বস্থ বোধ করলেন তিনি।
মাহতাব খান আরো খুশী হলেন সাগরকে দেখে। কি পরিবর্তন ওর ভিতর। শহরের বাড়ীতে খেলাধুলার সাথী আর খোলা মেলা জায়গা না পেয়ে যে সাগর সব সময় মন খারাপ করে থাকতো সেই সাগর এখন চৌধুরী এষ্টেটে মুক্ত বিহঙ্গের মত প্রাণ চঞ্চল।
নীলিমা চৌধুরীর জোরাজোরিতে রাত্রিতে অবস্থান করলেন তিনি।
অনেক রাত পর্যন্ত নীলিমা চৌধুরীর সাথে নানা বিষয়ে কথা হলো ওদের। পরবর্তিতে হাতে সময় নিয়ে লাবনীর মাকে নিয়ে আসার অঙ্গিকার করে পরদিন রওয়ানা হলেন।
যাওয়ার প্রাক্কালে লাবনীকে একপাশে ডেকে নিয়ে স্বস্নেহে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন -মাগো, নীলিমা চৌধুরী তোর মায়ের মত, ওর কাছে সব কিছু বলা যায়। আর আমিতো আছিই আমাকে জানাস তোর যে কোন সিদ্ধান্ত নি:সঙ্কোচে।
লাবনীকে খুব পছন্দ করেন নীলিমা চৌধুরী। আর ওর ছয় বছরের ছেলেটা বলতে গেলে তার সারাদিনের সাথী।
লাবনীর বাবার কাছ থেকে ওর সন্মদ্ধে সব কিছু জেনেছেন তিনি। প্রায় বছর খানেক হলো লাবনী এসেছে এখানে। এর মধ্যে ওর মুখে কখনো ওর স্বামী সম্পর্কে একটা কথাও শোনেনি। তবে ওর স্বামীর সাথে সব সময় যোগাযোগ আছে বলে ওর বাবা বলেছেন।
অনেকবার ভেবেছে কোন হালকা মেজাজের ফাকে প্রসঙ্গটা তুলবে নীলিমা চৌধুরী।
সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন। নীলিমা চৌধুরী নিজে হাতে নাস্তা তৈরী করেছেন। তিনি টেবিলে নাস্তা সাজাতে সাজাতে অমর ডাঃ লাবনী আর অনিরুদ্ধকে নিয়ে কথা বলতে বলতে প্রবেশ করলো।
নীলিমা চৌধুরীকে নাস্তা সাজাতে দেখে খুব খুশী হলো সবাই।
-মা তোমার হাতের বানানো নাস্তা, আহ কি মজা করে খাব আজ।
আনন্দের অতিশয্যে কিছুটা ছেলেমানুষীর সুর অমরের কণ্ঠে।
ভারী ভালো লাগলো নীলিমা চৌধুরীর।
-অমর, তোমারও যেমন মায়ের হাতে রান্না খাবার খেতে ইচ্ছে হয় আমারওতো তেমনি আমার ছেলে বউয়ের হাতের রান্না খেতে মন চায়, না কি? তুমি কি বল তোমরা?
মায়ের কাছ থেকে এসময়ে এমন একটা প্রস্তাব যেন একেবারেই অনাক্ষিত ছিল অমরের। একদম অপ্রস্তুত হয়ে গেল ও। মায়ের রশিকতার জবাবে হালকা কোন রশিকতা করার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেললো ও।
অমর ওর ছেলেমি ভরা অঙ্গসঞ্চালন বজায় রেখেই প্লেট থেকে অনাভ্যস্তভাবে খালি হাতে একটু গরম সব্জি আঙুলের আগায় তুলে ফু দিতে দিতে বললো -ডাঃ লাবনী না হয় মাঝে মাঝে তোমাকে রান্না করে খাওয়ালো, তাহলে হবেতো।
কোন পূর্ব প্রস্তুতি বাদেই কথাটা বলেই ও থেমে গেল হটাৎ করেই। কি যে বলে ফেললো তা যাচায় করার জন্য।
আর কিছু না বলে নিঃশব্দে চেয়ারে বসলো অমর। কিছুটা হতবুদ্ধি।
হতচোকিত হয়ে রইলো অন্যান্য সকলে। সবাই তাকিয়ে ওর দিকে। কি বললো অমর? বোধহয় সেটা যাচায় করার জন্য।
-ঠিক আছে, রান্নার ব্যপারে মাঝে মধ্যে অমর চৌধুরীর স্ত্রীর প্রক্সিটা না হয় আমি দেব। কিন্তু তাতে কি মায়ের মন ভরবে? তিনি তো চান পাকাপোক্ত একটা বন্দোবস্ত।
স্মিত হেসে কথাগুলো খুব হালকা ভাবে বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করলো ডঃ লাবনী।
-আমি আর অনিরূদ্ধ মিলে না হয় পাত্রী খোজ করার দায়িত্ব নিলাম, কি বল অনিরুদ্ধ।
একটু থামলো লাবনী।
-অমর চৌধুরীর মত পাত্রের জন্য পাত্রীর ঘাটতি হবে না। শুধু ঠিকমত বাছাই করতে হবে। কিন্তু অমর চৌধুরীর নিজস্ব কোন পছন্দ থাকলে সেটা জানার দরকার প্রথমে আমাদের মিসেস চৌধুরী।
অনিরূদ্ধর মন্তব্যে সবাই তাকালো অমরের দিকে।
ছেলেকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য প্রসঙ্গটার মোড় ঘুরাতে চায়লেন নীলিমা চৌধুরী।
-তা অনিরূন্ধ তোমার ব্যপারটাই বা কি বলতো? তোমার বিয়ের অনুষ্ঠান আমি এই চৌধুরী এষ্টেটেই করবো সেটা জেনে রেখ।
-সে সৌভাগ্য আমার হবে না মিসেস চৌধুরী।
রশিকতার উত্তরে অনিরূদ্ধর এধরণের একটা সরাসরি নিরস জবাব বোধহয় সবাইকে আশ্চার্য্য করলো একটু।
-বিয়েটা না হয় আমাদেরকে না জানিয়ে চুপি চুপি করো। কিন্তু বউটাতো আমাদেরকে দেখাবে, না কি।
নীলিমা চৌধুরীর হালকা রশিকতায় কেমন যেন একটু বিমর্ষ দেখালো অনিরূদ্ধকে।
-চুপি চুপি বা প্রকাশ্যে কোন ভাবেই বোধহয় সম্ভব নয়।
হালকা রশিকতার উত্তরে স্পষ্ট আর আবেগশুণ্য জবাব অনিরুদ্ধর।
অনরিূদ্ধ এভাবে জবাবটা না দিলেও পারতো। ভাবলো অমর।
এই হালকা রশিকতাকে অত সিরিয়াস করাটা ওর ব্যক্তিত্বের সাথে একেবারেই বেমানান। ওর হটাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়াটাও সবাইকে একটু অবাক করলো।
-অনিরূদ্ধর বোধহয় অন্য ব্যাপার আছে মা। খামাখা ওকে বিব্রত করা কেন।
পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললো অমর।
অনিরূদ্ধর মুখাবয়বে কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না।
-চির সবুজ বৃক্ষরাজি কেমন নীপুন ভাবে সব ঋতুর সাথে খাপ খাইয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু পত্রপতনশীল গাছগুলো, বেচারা ঋতু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে কেমন মরার মত হয়ে বেচে থাকে। অমন একটা রূদ্র রূপ সেতো সে আর সখ করে ধারণ করে না। করে বাচার তাগিদে। তাতে যদি কেউ ওকে বেরশিক বলে তো বলুক না। ওর কি করার আছে।
কিছুটা অন্য মনষ্ক অনিরূদ্ধ। যেন এক অচেনা মানুষ।
ওর কথা শুনতে শুনতে সবাই গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। সে দিকে খেয়াল হওয়াতে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল অনিরূদ্ধ।
জোর করে হাসলো একটু।
-অতিথি পাখী দেখেছেন না মিসেস চৌধুরী। শীতের সময় দলে দলে, ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে ওরা সইবেয়িার জমাট বাধা হীম শীতল বরফের হাত থেকে জীবন বাচানোর তাগিদে। এখানে এসে ওরা হাসে, গায়, ছোটাছুটি করে। করতে হয় তাই করে।
একটু স্বাভাবিক হয়ে কথাটা বলতে বলতে আবার অন্যমনষ্ক হয়ে গেল অনিরূদ্ধ।
সবাই তাকিয়ে ওর দিকে। কি বলছে এসব অনিরূদ্ধ।
বেশ কিছুদিন ওর সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে কাজ করলেও এ মুহূর্তে অনিরূদ্ধকে একদম অচেনা লাগায় তার দিকে তাকিয়ে রইল লাবনী।
এখানকার সবার সাথে ওর সম্পর্কটা কাজের ব্যাপারে হলেও কেবল লাবনীর সাথে কিছুটা অনানুষ্টানিক। বেশ কিছু দিনের পরিচয় ওর অনিরূদ্ধর সাথে কিন্তু ওর এ চেহারাটা প্রথম দেখছে।