জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -১৭।

আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০৪

জীবনের অন্যপিঠ- ১৭

 

নীলিমা চৌধুরীর সাথে তার ছেলে অমরের সম্পর্কটা অতটা উষ্ণ নয়। ছেলের জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মায়ের সাথে সম্পর্কটা চিরকালই অল্পদিনের দেখা সাক্ষাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর জমিদারীর ভার নেয়ার পর অমর একটু যেন বেশী করে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে বলে নীলিমা চৌধুরীর কাছে প্রতীয়মান হয়।
জমিদারী আর বিভিন্ন কর্মকান্ডের বাইরে যেন কিছুই ওর অভিধানে নেই। মনে হয় যেন কাজের মধ্যে কিছুটা জোর করেই ও নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। ব্যপারটা ধীরে ধীরে নীলিমা চৌধুরীর চোখে প্রকট হয়ে উঠতে লাগলো। নানা কথা বার্তায় বা আকারে ইঙ্গিতে সেটা ছেলেকে বোঝাতে চেয়েছেন অনেক বার কিন্তু কোন ফল হয়নি।
শেষে একদিন সন্ধ্যার পর নীলিমা চৌধুরী ছেলেকে ডাকলেন তার ঘরে।
সাংসারিক দুএকটা কথা বলার পর সেদিন তিনি ছেলেকে তার নিজের জীবন সম্পর্কে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করলেন।
মায়ের ঈঙ্গিতটা বুঝলো অমর।
-এতসব ব্যস্ততার মধ্যে এসব না হয় থাক।
-এটাতো থাকার ব্যপার নয় খোকা। সব কিছুরই একটা সময় আছে। আর ঠিক সময়ে বিয়ে করে সংসার করার ব্যপারে অযথা সময় নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
-এ নিয়ে অত চিন্তা করতে হবে না তোমার। একদিন আমি সময় করে এ ব্যপারে আমার পরিকল্পনার কথা তোমাকে বলবো।
আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্য কথাগুলো ছেলে বললো সেটা বুঝলেন তিনি।
কথা শেষ করে অমর দাড়ালো না একটুও। কিছুটা অস্থিরতার সাথে বাইরে চলে গেল।
অবাক হয়ে বসে রইলেন নীলিমা চৌধুরী।

কি বলার আছে অমরের এ ব্যপারে! ওর কি নিজস্ব কোন পছন্দ আছে? তবে সেকথা বলতে আলাদা সময়ের দরকার কেন!

-ঘরে আছেন চৌধুরী মা।
রামদয়ালের গলা। চিন্তায় ছেদ পড়ল নীলিমা চৌধুরীর।
-আয়, রামদয়াল ভিতরে আয়।
সাধারণত সন্ধ্যের পর এ সময়েই রামদয়াল আসে নীলিমা চৌধুরীর কাছে। জমিদারীর বিভিন্ন কাজ কর্মের ব্যাপার সহ অন্যান্য ব্যপারে আলোচনা হয়। এ বাড়ী আর জমিদারীর সব ব্যপারগুলোই রামদয়ালের নখদর্পনে। ওই সবচেয়ে পুরনো মানুষ এই পরিবারের।
-খোকাবাবু কেমন যেন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, চৌধুরীমা?
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো রামদয়াল।
-কিচ্ছু ভালো লাগে না আর, কেউ আমার কোন কথা শোনে না।
-কি বলছেন চৌধুরীমা, আপনি জীবিত থাকা পর্যন্ত সব কিছুইতো আপনার কথায় চলবে। খোকাবাবুর অক্লান্ত পরিশ্রমে জমিদারীতে আবার নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে। জমিদারী আবার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাচ্ছে। প্রাণের উচ্ছলতায় সবাই কাজ করছে। কোন ভুল হলে আপনিই তাকে শুধরে দেবেন।
-ওসব ঠিক আছে কিন্তু --
একটু থামলেন নীলিমা চৌধুরী।
-ও তুই বুঝবি না।
অবাক হয়ে তাকালো রামদয়াল নীলিমা চৌধুরীর মুখের দিকে। বিহব্বলতায় ভরা সে মুখ, ব্যথিতও বটে।
কি এমন ঘটতে পারে! এই পরিবার বা জমিদারীতে যার একটুও আচ করতে পারছে না রামদয়াল।
ওর অভিব্যক্তিটা বোধহয় বুঝলেন নীলিমা চৌধুরী।
-খোকা বড় হচ্ছে না, ওর বয়সতো আর বসে নেই। জমিদারীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমার মুখের উপর বলে গেল এসব নিয়ে নাকি চিন্তা করতে হবে না আমাকে।
কথা শুনে মৃদু হাসলো রামদয়াল।
-তা খোকাবাবুতো ঠিকই বলেছেন। এতবড় জমিদারী একক পরিকল্পনায় চালাচ্ছে আর এমন একটা ব্যপারে তিনি ভাববেন না তা কি হয়। নিশ্চয় সে ব্যপারে কোন পরিকল্পনা তার আছে।
রামদয়ালের কথাটা একটু হেয়ালীপূর্ণ লাগলো।
কিন্তু রামদয়ালতো হেয়ালী করার মানুষ না। আর এমন একটা ব্যপারে ও হেয়ালী করবে না সে ব্যপারে নিশ্চিত নীলিমা চৌধুরী।
-চোধুরীমা, গত বাৎসরিক কাঙালীভোজটা তো চৌধুরীবাবার এক বছর মৃত্যু বর্ষিকী ভোজের সাথে মিলিয়ে দেয়া হলো। দেখতে দেখতে বছর প্রায় গড়িয়ে গেল, এবারকার কাঙালীভোজটা বর্ষা পড়ার আগেইতো শেষ করা দরকার।
জমিদারীর কি কি ঐতিহ্য, সেই আমল থেকে বিভিন্ন দিন যেমন দুই ঈদ, সবে বরাত ইত্যদি দিনগুলোতে চৌধুরীমাতা দরীদ্র প্রজাদের মধ্যে কি কি বিতরণ করবে, প্রত্যেক ঋতুর শুরূতে জমিদারের গন্য মান্য ব্যক্তিদের নিয়ে পাক্ষিক সভা ইত্যাদি এ পরিবারের কারোরি পুরোপুরি জানা নেই। আর লিখিতভাবেও তেমন কিছু নেই। কিন্তু সব কিছুই রামদয়ালের নখদর্পনে, সে সবের কোন কিছুই ওর নজর যেন এড়ানোর নয়।
কথায় কথায় নীলিমা চৌধুরী একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন রামদয়ালকে এত সব ওর মনে থাকে কি করে?
-শরীরের কোন অংশে ব্যথা করলে, তা কি অন্য কাউকে মনে করিয়ে দিতে হয় চৌধুরীমা?
হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিলো রামদয়াল।
-ঠিক আছে, তুই ব্যবস্থা কর রামদয়াল। তুই না থাকলে কি যে হতো। দেখি খোকাকে বলবো এধরণের সব অনুষ্ঠানের একটা লিষ্ট ছাপিয়ে ওর অফিসে টাঙিয়ে দিতে।
-সেটাতো খুব ভালো হয়। তবে আমি বেচে থাকা পর্যন্ত এ ব্যপারে আপনার কোন চিন্তা করতে হবে না।
ওর কথা শুনে নীলিমা চৌধুরী একটু অন্য মনষ্ক হয়ে গেলেন। হটাৎ করেই কি একটা প্রসঙ্গ যেন স্মরণে আসলো তার।
-রামদয়াল তুইতো খোকার থেকে ক’বছরের বড়। তা তোরওতো বিয়ে থা করা দরকার। নয়লে তুইতো তোর বাবারটা সামলালি কিন্তু তোর কাছ থেকে এতসব বুঝে নেবে কে শুনি? আর তোরতো একজন সাথীরও প্রয়োজন আছে।
নীলিমা চৌধুরীর কথায় একটু বোধহয় লজ্জা পেল ও।
-অত চিন্তা করবেন না চৌধুরী মা। ততোদিনে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার দিনও শেষ হয়ে যাবে। আর প্রয়োজনের কথা বলছেন চৌধুরীমা, সব কিছুর প্রয়োজন কি সবার কাছে সমান!
-তুই যা বলতে চাস খুলে বলতো?
-এই ধরূন খোকাবাবুর কথা। আপনি তার জন্য যেটা প্রয়োজন ভাবছেন সেটাকে খোকাবাবু আমলই দিচ্ছে না। ওর প্রয়োজন বোধহয় অন্যকিছু যা কোন কারণে হয়তো কাউকে বলতে পারছে না।
-তোকে কি কিছু বলেছে খোকা?
কোন জবাব দিল না রামদয়াল।

স্বামী আমির চৌধুরী এই বিরাট এস্টেটে তার নিঃসঙ্গ দিন গুলোতে নীলিমাকে কাছে পেতে চায়তো কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবেও রামদয়াল চুপ করে ছিল।
তবে পরে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলো -চৌধুরীমা, মানুষের প্রয়োজনটা অনেকটা জীবন্ত গাছের সাথে তুলনা করা যায়। গাছটা যতদিন কাচা থাকে ততোদিন সেটার পানির চাহিদা থাকে। তারপর পানি না পেয়ে পেয়ে একবার যখন ওটার শরীর থেকে সব রস শুকিয়ে যায় তখন পানির প্রয়োজন আর থাকে না ওটার। এমনি পরিস্থিতিতে পানি ঢাললেও গাছটা আর শুষতে চায় না। তারপরেও বেশী বেশী করে পানি ঢাললে সেটা মরেও যে বেচে ছিল সে ভাগ্যটুকু থেকেও বঞ্চিত হয়। মৃত দেহটা অবশেষে পানি শোষণ করে পচে গলে মাটি হয়ে যায়।
রামদয়ালকে চিরকালই একটু হেয়ালী মনে হয়। কোন কিছুই যেন ও গায়ে লাগাতে চায় না। ওর হিসাবে -বিধাতার এ পৃথিবীতে সব কিছুই ঠিক ঠাক মত চলছে, দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
ওকে নিয়ে কখনো তেমন গভীরভাবে ভেবে দেখেনি নীলিমা চৌধুরী। আলাদা ভাবে ভাববার মত তেমন কোন গুরূত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব না রামদয়াল। তাই ওকে সকল কাজে প্রয়োজনীয় মনে হলেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়নি কখনো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে রামদয়াল জড়িয়ে আছে চৌধুরী এষ্টেটের সকল কর্মকান্ডে প্রচ্ছন্নভাবে। ও সব জায়গাতেই আছে আবার যেন কোথাও নেই।
নীলিমা চৌধুরী একদিন ওকে জিজ্ঞেস করলো অনিরূদ্ধ সম্পর্কে।
-আচ্ছা রামদয়াল, অনিরদ্ধর ব্যপারটাই বা কি বলতো? অমন সুশ্রী সবল একজন যুবক ছেলে, সারাক্ষন কেবল পাগলের মত ব্যস্ত থাকে রোগীদের নিয়ে। ডাক্তারীর বাইরে অন্যান্য সব সামাজিক কাজ, খোকার অন্যন্য সব প্রজেক্ট ইত্যদির মধ্যেইতো ডুবে থাকে সব সময়। ওর কি ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু নেই না কি?
হাসলো রামদয়াল। সেই হেয়ালীভরা হাসি ওর। যেন সব জানে আবার যেন কিছুই জানে না।
-যে কোন মেয়ের চোখে ও আদর্শ একজন স্বামী, তুই কি বলিস?
-লাবনী আপামনিও অনিরূদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা আপনার মতই ধারণা পোষন করে।
লাবনী অনিরূদ্ধকে পছন্দ করে সেটা ওর কথাবার্তা বা অনিরূদ্ধর প্রতি ওর বিভিন্ন মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। বিভিন্ন সময়ে লাবনী অনিরূদ্ধর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আকাক্ষা প্রকাশ করে। অনিরূদ্ধ সম্পর্কে লাবনীর এই আগ্রহের স্বরূপটা কি সেটা বোধগম্য নয় নীলিমা চৌধুরীর।