জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -২১।

আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৪৭

জীবনের অন্যপিঠ -২১ 

 

সেদিনই গভীর রাতে নীলিমা চৌধুরী ডাকলেন রামদয়ালকে।
এত রাতে চৌধুরী মা ডাকেন না কখনো। বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো ওর।

নীলিমা চৌধুরীর দরজার একটা কপাট খোলা। পর্দার ফাক দিয়ে আলোর রশ্মি চোখে পড়ছে।
চিরকালের অভ্যাসবসতঃ দরজার সামনে দাড়িয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিল রামদয়াল।
-ভেতরে আয় রামদয়াল।
ভারী আর গম্ভীর কণ্ঠ। কিছুটা বিরক্তিভরা বলে বোধ হলো।
ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলো নীলিমা চৌধুরী একটা বড় হাতাওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন। আর অদুরেই অন্য একটা চেয়ারে বসা অমর।
কেউ কোন কথা বলছে না।
-তোর চৌধুরী বাবা বেচে থাকলে এত সব নিয়ে আমাকে ভাবতে হতো না। কিন্তু এখন এগুলো নিয়ে আমি ছাড়া আর কে ভাববে বল?
কিছুটা ধরা গলায় কথা গুলো বলে নিস্তব্দতা ভাঙলেন নীলিমা চৌধুরী।
কি বলবে তা ঠিক করে উঠতে পারলো না রামদয়াল।
-আমি জানিনা এতসব কিছু করার কোন অধিকার আমি অর্জন করেছি কিনা। কিন্তু এখন আমার কি করার আছে! আমিতো সবকিছু ছেড়ে দিয়েই এসেছি। এই চৌধুরী এষ্টেটেই কাটাতে হবে যে কয়টা দিন হাতে আছে। এ ছাড়া আমার যে যাওয়ার আর জায়গা নেই।
কাঁদতে লাগলেন নীলিমা চৌধুরী।
-ও কথা বলবেন না চৌধুরী মা। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ ক্ষনেকের জন্য আত্মভোলা হতেই পারে। তায় বলে কি মানুষ তার অস্তিত্বকে ভুলতে পারে, এ কি ভুলবার মত কিছু।
নীলিমা চৌধুরীর অপরাধ ভরা মনটা কিছুটা হালকা করতে চায়লো রামদয়াল।
- এ বংশের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে আপনি ছাড়া আর কে ভাববে বলুন? বললেই হলো যে এগুলো নিয়ে ভাববার কোন দরকার নেই।
মা ছেলের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুটা আচ করলো রামদয়াল।

একটু শান্ত হলেন নীলিমা চৌধুরী।
-অমরের যদি নিজের কোন পছন্দ থাকতো, তা যা কিছুই হোক না কেন আমি তা মেনে নিতাম, একটুও বাধা দিতাম না।
একটু থামলেন তিনি।
-লাবনীর কোন দিকে অযোগ্যতা আছে তুই বল, আর খোকাই আমাকে বোঝাক। লাবনীর আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, ও একটা সন্তানের জননী, এটাই কি ওর অযোগ্যতা?
-সেরকম কোন কথাতো কখনো আমি বলিনি মা।
বিরক্তি ভরা কণ্ঠ অমরের।
-তবে? মানুষের জীবনে কি এক্সিডেন্ট ঘটে না।

লাবনীকে খুব ভালো লাগে অমরের। ওর উপরের সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায় ওর দেহাবয়বে, চলন আর বলন ভঙ্গিতে, যা যে কোন কাউকেই আকর্ষন করে। আর ওর ভিতরকার সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায় ওর ব্যক্তিত্বে, কর্মে, একাগ্রতায় আর মানুষের প্রতি মমোত্ববোধে। ওর এদিকটার সন্ধান যে পেয়েছে সেত ওর সান্নিদ্ধে নিজেকে ধন্য মনে করবে।
ভাবলো অমর।
-তুমি যা ভাবছো তার কিছুই না মা। লাবনীর মত একজনকে খুজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর।
-তাহলে?
-সে কথা তোমাকে আমি বলতে পারবো না।
-কেন, তোমার নিজের কথা শোনার কি কোন অধিকার কি আমার নেই?
-সে কথা বলিনি আমি।
-তবে আমাকে খুলে বল সবকিছু।
একটু বিরক্ত হলো অমর।
-তোমাকে এখন আমি কিছু বলতে পারবো না।
অমরের এ ধরণের উত্তরে একেবারে অধৌর্য্য হয়ে উঠলেন নীলিমা চৌধুরী।
-তুমি যখন আমাকে কিছু বলবে না, তাহলে আমাকে আমার মত করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
-তোমাকেতো আমি নিষেধ করিনি মা।
ছেলের এহেন জবাবে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন নীলিমা চৌধুরী।
-ঠিক আছে, তায় আমাকে করতে হবে। রামদয়াল কালই তুই উকিলকে খবর দে, আমি উয়িল করে এ সবকিছু ট্রাষ্টের কাছে হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করবো। চোখ বোজার আগে সব বন্দোবস্ত করে যাব।
আতকে উঠলো রামদয়াল।
কোন মন্তব্য না করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল অমর।
-আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন চৌধুরী মা! এমন কাজ কখনোই করবেন না। একটু ধৌর্য্য ধরূন, আমি বলছি সব ঠিক হয়ে যাবে।
-কি ভাবে ধৌর্য্য ধরবো? আর ধৌর্য্য ধরলেইতো সময় বসে থাকবে না। জমিদারীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাকেইতো ভাবতে হবে।
কাঁদতে লাগলেন নীলিমা চৌধুরী।
-সে কথা ঠিক চৌধুরী মা। তবু ও আমি বলছি অধৌর্য্য হওয়ার তেমন কোন কারণই নেই।

এত জরুরী একটা বিষয়ের ব্যাপারে রামদয়ালের এই স্বাভাবিক মনোভাব লক্ষ্য করে নীলিমা চৌধুরী একটু অবাক হয়ে তাকালেন ওর দিকে।
-চৌধুরী মা, চৌধুরী এষ্টেটটা আমার শরীরের মত। অন্য সব কিছু বোঝার ক্ষমতা না থাকলেও এ ব্যাপারটা আমি বুঝি।

রামদয়াল আর দাড়ালো না মাথা নিচু করে চলে গেল।
নীলিমা চৌধুরী হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

জামিদারী এবং চৌধুরী এষ্টেটের যে পরিবর্তন, যে উন্নতি, তা যে কোন উদাস মানুষেরও দৃষ্টিকে আকর্ষন করবে।
জমিদার পরিবারের সাথে প্রজাদের যোগাযোগ বেড়েছে। রাস্তা ঘাটের প্রভূত উন্নতী হয়েছে। চৌধুরী এষ্টেটের প্রতিটি গাছ পালা যে খুশীতে ভরে উঠেছে, যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে তার প্রকাশ ওদের ফুলে ফলে। সমস্ত চৌধুরী এষ্টেট ফুলে ফলে ভরে উঠেছে।
অনেক বছর পর গত শীতে অতিথি পাখির ঝাকও এসেছিল দিঘিতে, সাত সমুদ্র পার হয়ে। সকালে পাখীর কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভাঙে চৌধুরী এষ্টেটের মানুষদের এখন।
রামদয়াল আগের মত কুঁজো হয়ে হাটে না। লাঠি ফেলে দিয়ে মাজা সোজা করে হাটে ও। চোখে চশমাও না দিলেও চলে আজ কাল।
কিন্তু যে দিকটা সবার দৃষ্টিকেই এড়িয়ে গিয়েছে তাহলো চৌধুরী এষ্টেটের চালিকা শক্তি যে মানুষগুলো তাদের এতসব কর্মচাঞ্চল্যের বাহিরাবনের আড়ালে ঢাকা পড়া ওদের ভিতরের মানুষগুলো।

ডাঃ লাবনী আর অনিরূদ্ধ দুজনই নিজের থেকেই চৌধুরী এষ্টেটের সবকিছুকেই আপন করে নিয়েছে।
কাউকে দেখলে মনে হয় না ওরা কিছুর বিনিময়ে এখানে কাজ করে। বেতন ওরা ঠিকই নেয় তবে সেটা মনে হয় একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। চৌধুরী এষ্টেটে ওদের অবস্থানের লৌকিক উপলক্ষ চাকরী হলেও, এখানে কাজ করার প্রয়োজন যেন ওদের কাছে তার থেকে আরো অনেক গভীরে।
জমিদারীর দায়িত্বটা বুঝে নেয়া অমরের কাছেও কেবল বৈষয়িক হিসাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ওর প্রকৃত হিসাবটাও কেবলমাত্র লৌকিক হিসাবের মাপকাঠিতে বাধা নয়।

কিন্তু রামদয়ালের মনের জোর কমে যাচ্ছে কেন! ওর মনটা উদাস হচ্ছে কেন! কিসের পদধ্বনি এসব! টিম টিম করে জ্বলা প্রদিপটা সমুজ্বল হওয়ার পর একটা দমকা হাওয়াই নিভে যাবে সব!

হটাৎ একদিন শুক্রবার ছুটির দিনে খুব ভোরে রামদয়ালকে ডেকে পাঠালো অমর ওর অফিসে।
ডাঃ অনিরূদ্ধ আর লাবনী বসে আছে নীরবে। রামদয়ালকেও বসতে বললো অমর।