জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' - ৮ম পর্ব

আপডেট: ১৪ Jun ২০২২, ১৫:২৮

                                                               অমৃতের সন্ধানে - ৯ম পর্ব

শিউলিকে প্রথম দেখাতেই মানিকের মনে হয়েছে কেন জানি ও অনেক দিনের চেনা কেউ। একটা সৌম্য শান্ত ভাব সব সময়ই ওর মুখের উপর লেপটে থাকে। এমনই একটা মুখের সন্ধান মানিক করে সব সময়।

-বোধহয় এতদিনে ওর আশা পূর্ণ হয়েছে। ওকে বোধহয় অনেক কথা বলা যায়, শোনার মত মন আর ধৌর্য্য ওর আছে। মানিকের কথা ও বুঝতে পারবে।

মানিক ভাবে মনে মনে।

-আচ্ছা একটা জীবনের লক্ষ কি হতে পারে বলে আপনার মনে হয়। বিনা সংকোচে প্রশ্নটা করলো মানিক।

শিউলি একটু অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে।

-শুধু পাওয়ার মধ্যেই কি আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তি? তা কি করে হয়, কারণ পাওয়ারতো কোন শেষ নেই। একটা পাওয়া আর একটা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে উসকে দেয়। পাওয়ার হিসাব রাখতে যারা ব্যস্ত, জীবনটা তাদের আকাঙ্ক্ষার ভারেই নুইয়ে থাকে। মাথা উঠিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার ফুসরত তাদের কোথায়। ওরাতো আকাঙ্ক্ষার দাস।

শিউলিকে এত সব কথা বলতে ভীষণ ভালো লাগছে মানিকের।

-হিসাবী মানুষগুলো হিসাবের একটু অমিল হলেই তারা খুব অধৌর্য্য হয়ে ওঠে। ওখন হাতের নাগালের মধ্যে যা পায় সেখান থেকেই নগদ নগদ হিসাবটা মিটিয়ে নিতে চায়। লিফট দিয়ে উপরে উঠতে যারা অভ্যস্ত ওরা সব সময় হাতে অল্প সময় নিয়ে আসে, তখন যদি ওভার লোডের কারণে লিফটে জায়গা না পায় তখন তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। আর লিফটটা কোন কারণে যদি বিকল হয়ে যায় তবে অধৌর্য্য হয়ে ওরা যে কোন কিছু করে বসতে পারে।

মানিক একটা দীর্ষ নিশ্বাস ফেললো। শিউলি ওমনি ভাবেই তাকিয়ে ওর দিকে।

-আর হারানো দিয়েই যাদের হিসাবটা শুরূ হয়েছে ওদের জীবনটা কি তাহলে ব্যর্থ? হিসাবের অংকগুলোই কি জীবনের সার্থকতা নির্ধারন করে?

জবাবের অপেক্ষা না করেই মানিক একটু থেমে আবার বললো- হারাতে যারা অভ্যস্ত এদের একটা সুবিধা আছে, হারানোর নির্মম কষাঘাত এদেরকে এমনভাবে জর্জরিত করে যে, এরা নতুন কোন আকাঙ্ক্ষা করতে ভূলে যায় বা ভয়ও পায়। জীবন প্রবাহ যদি কখনো কখনো সৌভাগ্যের ছিটে ফোটা এদেরকে দান করে তখন সেটা হয়ে ওঠে অমৃত।

শিউলি কোন জবাব দিল না। তেমনি ভাবেই স্নেহভরে ওর চুল গুলো আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো।

মানিক একটু সরে শিউলির গাঁ ঘেঁসে বসলো।

-একটা নিরাপদ জীবনই কি সকল প্রচেষ্টার লক্ষ! তাহলে হৃদয়ের স্থানটা কোথায়। মান অভিমান ভালবাসা এগুলোর স্থান কোথায়?

তেমনি ভাবেই তাকিয়ে রইলো শিউলি।

কি জানতে চায় মানিক ওর কাছ থেকে।

শিউলির বিহ্বলতা দেখেই বোধহয় প্রসঙ্গ পালটালো মানিক।

একটু থেমে ও আবার বললো- স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরূ হয়েছে, দেশ তো স্বাধীন হবেই, কিন্তু তার জন্য সাধ্য মত সবাইকে কিছু না কিছু করা দরকার। পালিয়ে আর কতজন বাচবে। এ বিশাল পৃথিবীতে এই দেশটাই আমাদের, জন্ম সবার এখানেই আর দেশটাকে বসবাস উপযোগী রাখার জন্য যা দরকার তার সবকিছুই আমাদেরকেই করতে হবে।

শিউলি কিছু একটা বলার আগেই পুনরায় মানিকের কণ্ঠ- আপনিতো বসেই থাকেন, তা একটু সময় বেধে দিয়ে গ্রামের গরীব রূগীদের চিকিৎসা করেন না কেন? তাতে মানুষেরও উপকার হবে আর আপনারও দক্ষতা বাড়বে।

শিউলি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। কি যেন একটা চিন্তা করলো তারপর ধীরে ধীরে সন্তর্পনে ওর চুল থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো।

-আপনারা মানে মেয়েরা অসম্ভব রকমের ভাগ্যবতী। ভালোবাসা দিয়ে দুনিয়ার সব কিছুই জয় করা যায় আর আপনারা হচ্ছেন সেই ভালোবাসার আধার, যা কখনো শেষ হয় না।

চাঁদটা প্রায় মাথার উপর চলে এসেছে। মেঘমুক্ত আকাশে গোল চাঁদটা একটা স্বপ্নিল পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।

-একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

শিউলি একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। না দিতেই নিজ থেকেই এত অধিকার যে আদায় করে নিয়েছে তার আবার অনুমতি দরকার কি? ভাবলো শিউলি।

কি জিজ্ঞেস করবে মানিক ওর কাছে। বেলালের কথা। বেলালকে নিয়ে গভীরভাবে শিউলি ভাবিনি কখনো। যা কিছু অল্পতে বোঝা বা দেখা না যায়, মানুষ কেবল সেগুলো নিয়েই ভাবে আর মনে সেগুলো দেখার বা বোঝার ইচ্ছা জাগে।

জ্যোৎস্নায় সবই দেখা যায় কিন্তু ভালভাবে পরিস্কার করে দেখা যায় না, আবছা আবছা যাও বা দেখা যায় তা সেগুলো আবার ঠিকমত বোঝা যায় না। আলো আধারির খেলায় সব কিছুই অচেনা রহস্যময় লাগে। তায়তো জ্যোৎস্না কবিতা হয়ে গল্প হয়ে সহস্র মানূষের আকাঙ্ক্ষাকে জিইয়ে রাখে।

বেলাল জ্যোৎস্না আপ্লুত রাতের মত নয়। ও হচ্ছে মেঘমুক্ত আকাশে মধ্যদিনের সূর্যালোকের মত। তায়তো বেলাল সম্পর্কে কোন অস্পষ্টতা নেই। ওকে নিয়ে তায় কখনো গভীর ভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন হয়নি।

-হ্যঁ বলো। দ্বিধান্বিত কণ্ঠ শিউলির।

-আমি বলতে চায়, যেখানে যেমন, আর মেয়েরাতো প্রকৃতির মত। প্রকৃতির সাথে তাল মিলালেই আপনাদের মানায়। এক এক ঋতুতে প্রকৃতির যেমন এক এক রূপ, মেয়েদেরও ঠিক তেমনি। প্রকৃতি যদি কোনদিন মানুষের কাছে একঘেয়ে হয়ে যায় মানুষ সেদিন নিশ্চিত অত্মহত্যা করবে। পৃথিবী নিরর্থক হয়ে যাবে। প্রকৃতিকে পুরোপুরি জানা যায় না বোঝা বা জয় করা যায় না বলেইতো ওকে জানা বোঝা আর জয় করার তাড়না আছে।

শিউলি কথা গুলো নির্বাক হয়ে শুনছিলো। জীবন এত অল্পতেই মানিককে এত কিছু শিখিয়েছে, ভাবলো ও।

-আপনি শাড়ী পরেননা কেন? যেখানে যেমন, যে পোশাক আপনি পরে আছেন, এই পোশাকে আপনাকে বড় শহরে মানাবে, অপরূপা মনে হবে, আর লন্ডনে তো বটেই। কিন্তু প্রকৃতি যেখানে কথা বলে, সেখানে প্রকৃতির অংশ হয়ে তার সাথে খাপ না খাওয়ালে বেখাপ্পাতো লাগবেই।

শিউলি একটু নড়েচড়ে বসলো। এমন আপন করে এত দাবী নিয়ে কেউ কখনো ওর সাথে এভাবে কথা বলেনি।

এত অল্প পরিচয়ে এ ধরনের মন্তব্যে রাগ হওয়ারই কথা। কিন্তু ওর একটুও রাগ হলো না বরং মানিকের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ একটা কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মাতে লাগলো। এই সল্প পরিচয়ে এত অধিকারের শক্তি ও পেলো কোথা থেকে?

মানিককে নিয়ে একয় দিনে অনেক ভেবেছে ও । মানিকের মা মারা যাওয়ার সময় ছোট্ট মানিককে দেখেছিলো শিউলি। কিন্তু এ মানিকতো সেই ছোট্ট অবুঝ শিশুটি নয়। হারানোর বেদনা, বঞ্চিতের কষ্ট সব কিছুর আসল রূপটা উদঘাটন করতে ওর সহায়ক হয়েছে।

নানীর কোলে গুয়ে শুয়ে নানীর গায়ের গন্ধ শুখে ওর মায়ের গন্ধ কেমন মানিক তা জিজ্ঞেস করতো। নানীর বুকের মধ্যে মুখটা গুজে সবার অলক্ষে মানিক নীরবে ছোট্ট বাচ্চার মত কাঁদতো। নানী একদম নিশ্চুপ থাকতেন কিছুই বলতেন না জবাবে। যতক্ষন খুশী মানিক ওভাবেই মুখ লুকিয়ে থাকতো। তারপর ও নিজের মত করে আচলে চোখ মুছে উঠে বসতো। নানীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জা পেয়ে মৃদু হেসে উঠে চলে যেত।

অবলা একটা ব্যথায় রোকেয়া বেগমের বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হতো। কিন্তু ওর সামনে তিনি পাথর হয়ে থাকতেন। মানিক দূরে গেলে তিনি উঠে ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে কাঁদতেন।

কি অভিনব ভাবে এ দুটি জীবন নিজ নিজ দুঃখকে সংবরন করতো।

শিউলির মা মারা যাওয়ার পর রাঙাদাদির কোলে গুয়ে শুয়ে কথাগুলো শোনার পর থেকে শিউলি মানিককে দেখার একটা প্রচন্ড ইচ্ছা পোষন করতো মনে মনে।