জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' পর্ব -১৫

আপডেট: ১২ Jul ২০২২, ১৪:২৭

অমৃতের সন্ধানে -১৫ 

 

ঠিক হলো বর্তমান যুদ্ধের পরিস্থিতিতে শিউলি আর বেলালের বিয়েটা সম্ভব নয়। শিউলির বাবা বেলালের কাছে দুঃখও প্রকাশ করলেন।
বিয়েটা না হওয়াতে বেলাল দুঃখ করলো না বা তেমন ভাবে মন খারাপও করলো না। দুঃখ করলো শিউলি আর ওর বাবার বোকামির জন্য, আর মন খারাপ হলো যুদ্ধের মধ্যে শিউলির নিরাপত্তা বিঘ্নের আশঙ্কায়।
অবশেষে বেলাল অনেকটা অধৌর্য্য হয়ে একদিন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে ইন্ডিয়া হয়ে লন্ডনে চলে গেল।
যাওয়ার সময় ও সবার কাছে অকাতরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেল। তার লন্ডনে অনেক গুরূত্বপূর্ণ কাজ থাকাতে দেশের এই দূর্দিনে আপনজনদের পাশে না থাকতে পারায় দুঃখ প্রকাশ করলো। আর দেশ যাতে তাড়াতাড়ি স্বাধীন হয় তার জন্য আশাবাদও ব্যক্ত করলো।
এখানে বেশ কিছু দিন অবস্থান করাটা ওর কাছে সময়ের অপচয় হলেও ওর অবস্থান করাটা একেবারে নিরর্থক নয় বলেও মন্তব্য করলো বেলাল। এখানে থেকে নিজ চোখে পরিস্থিতি দেখা আর লন্ডনে বসে টিভি বা খবরের কাগজে পরিস্থিতি জানার মধ্যে অনেক পার্থক্য বলে সে মন্তব্য করলো। যে অভিজ্ঞতা সে চোখে দেখে অর্জন করেছে তা নিয়ে ফিরে যাওয়ার পর পরই বিবিসি বাংলা বিভাগে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করবে বলে জনালো।
সকলকে খুশি করবার জন্য সে আরো ঘোষনা করলো যে, সাক্ষাৎকারে সে তার সাথে পরিচিতদের নাম উল্লেখ করবে। সে প্রতিদিন ডায়রী লেখে এবং ডায়রীতে প্রয়োজনীয় সবার নাম নোট করা আছে বলে সবাইকে জানালো। অনুষ্ঠানটি মিছ না করার জন্য উপস্থিত সবাইকে বললো বেলাল।
বেলাল নিজেকে বাস্তববাদী বলে দাবি করে বর্তমান দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিয়েটা করতে রাজি না হওয়াই যাওয়ার প্রাক্কালে পুনরায় এটাকে শিউলির বোকামি বলে আখ্যায়িত করলো। আর ওর মামা অর্থাৎ শিউলির বাবার দূরদর্শিতা সম্পর্কেও নেতীবাচক মন্তব্য করলো।
যাওয়ার পূর্বে বেলাল অনেকটা গর্বভরে এই বলে মন্তব্য করলো যে, তার মামা এবং শিউলির এহেন পরিস্থিতি বিবেচনায় সে তার কর্তব্য করতে চেয়েছিল। যাহোক বিয়ের ব্যাপারটা দুপক্ষের ইচ্ছামত হওয়াই শ্রেয় বলে মন্তব্য করলো বেলাল।
যাত্রা শুরূ করার পূর্ব মূহুর্তে সকলের উপস্থিতিতে বিজয়দর্পে শিউলিকে উদ্দেশ্য করে বললো- আমি অপেক্ষা করবো তোমার জবাবের জন্য।

রাতের আধারে বেলাল রওয়ানা হলো, যাতে করে দিনের আলো ফোটার আগেই বর্ডার পার হতে পারে। পালিয়ে ইন্ডিয়া হয়ে লন্ডন চলে গেল বেলাল।
পালিয়ে গেল মানিকও।
শিউলির মনটা খারাপ তায় ও কয়েকদিন ধরে মানিকের খোজ নেয়নি। সেদিন সকালে রাঙা দাদির বুকফাটা কান্না শুনে ওর বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করতে শুরূ করলো। রাঙাদাদি বুকফাটিয়ে কাঁদছে। কি হলো রাঙাদাদির।
ও দৌড়ে গেল রাঙাদাদির ঘরের দিকে। অনেকে ভিড় জমিয়েছে। শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে। ও কিছুতেই কিছু মানছে না।
-আমার মানিককে এনে দে তোরা নাহলে আমি মরে যাব।
-তোদের জন্যই আমার মানিক চলে গিয়েছে। যুদ্ধ করার মত বয়স কি ওর হয়েছে। তোরা জোয়ান জোয়ান সবাই থাকতে ও একা কেন গেল। যদি যেতেই হয় তবে তোরা সবাই যা, কারো দরকার নেই আমার। দাড়িয়ে থাকা ছেলেদেরকে উদ্দেশ্য করে রোকেয়া বেগম কথাগুলো বলছিলেন।
গত রাতে অন্যান্য কিছু ছেলেদের সাথে মানিকও কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য।
মানিকের মা আমিনা বেগম ছিলেন বংশের বড় মেয়ে। তায় তার একটা বিশেষ স্থান ছিল এ পরিবারের সদস্যদের কাছে। তার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের সকল সদস্যের উপর শোকের ছায়া ফেলেছিল। আর তার রেখে যাওয়া দুধের ছেলে মানিকের প্রতি কমবেশি সবারই দুর্বলতা ছিল।
মানিকের এভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে যাওয়ার ঘটনায় সবাই ব্যথিত এবং হতচকিত হলো। সবাই ওকে খোজার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে লাগলো। গ্রামে আশ্রয় নেয়া কিছু কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলেদের সাথে মানিক গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য।
মানিকের নানী বাড়ীর পরিবারে কম করে হলেও দশ বারো জন সামর্থ্য পুরূষ ছিল যারা সে সময় মুক্তি যুদ্ধে যোগ দিতে পারতো। কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে অল্পবয়স্ক মানিকের মুক্তি যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারটা তাদের মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধের জন্ম দিল।
এক অজানা অপরাধবোধের জন্ম নিল শিউলির ভিতরও।
গত বেশ কিছুদিন যাবত শিউলি ওর রোগী দেখার কাজটা ঠিক ঠাক মত সংগঠন করা, যেমন প্রথমতঃ বাবাকে বোঝানো তারপর বসার জায়গা ঠিক করা, কিছু ঔষধপত্র কেনা, গ্রামের লোকজনদেরকে বলা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সর্বপরী রোগীদের দেখতে শুরূ করার পর ও যেন কাজে একদম ডুবেই ছিল, অন্য কিছু চিন্তা ওর মাথায়ই প্রবেশ করেনি।
তার উপর ওর বিয়ের ব্যপারে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া। বেলালের ব্যবহার, ওর কিছু মন্তব্য এ সব কিছু সত্যিই শিউলিকে অন্যমনষ্ক করে রেখেছিলো।
এত কিছু প্রতিকুলতার ভিতর ওর গ্রামের রূগীদেও নিয়ে ব্যস্ততাই প্রকৃতপক্ষে সব ঝেড়ে ফেলতে অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে নিঃসন্দেহে।
ভাবতে শিউলির অবাকই লাগলো। যার ধ্যান ধারণা আর অনুপ্রেরনায় ও কাজটা শুরূ করলো, তার কথাই বেমালুম ভুলে গেল! তা কি করে সম্ভব। যা কিছু করলো দেহে প্রাণ সঞ্চার, তাকে কি করে ভুলে থাকা যায়।
এমনটিই বোধহয় হয়। প্রকৃতির এমনটিই চায়। স্মৃতি বেচে থাকবে কর্মের মাঝে, কর্মী নশ্বর কিন্তু কর্ম অবিনশ্বর ঠিক প্রকৃতির মত।
আজ যেন শিউলি নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করলো। আবিস্কার করলো মানিককের অবস্থান ওর নিজের সত্তার গভীরে বিরাজমান, এমনিতে আছে কিনা বোঝা যায় না, সে চিন্তাই নিমগ্ন না হলে তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায় না।
মানিকতো ওর সাথেই ছিল, সথেই আছে ওর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে চিন্তা চেতনায়। মানুষ কি মনে করে করে নিঃশ্বাস নেয়! মানিককে মনে করতে হয় না কারণ কারণ অবস্থান হৃদয়ে অন্তরে, সেইতো চালিকা শক্তি। আত্মভোলা হয়ে মানুষ যখন কোন কাজ করে তখন দেহ থেকে মন কি আলাদা হয়ে যায়!
প্রকৃত পক্ষে শিউলি ওর নতুন কাজের মধ্যে নিজের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছার প্রতিফলনে নিজেকেই ভুলে গিয়েছিলো।
মানিককে ও ভুলবে কি ভাবে। মানিক ওকে যা দিয়েছে তার থেকে অনেক বেশী ও মানিকের কাছ থেকে নিয়েছে। মানিক ওর মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা একান্ত এক স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ।

শিউলি নিরবে ফিরে আসলো নিজ কক্ষে। ওর বুক ফেটে কান্না আসছিল। মনে হচ্ছিলো রাঙাদাদিকে জড়িয়ে ধরে ওর মত করে সেও একটু বুক খালি করে কাঁদে। মানিকের জন্য কাঁদতে পারলে মনটা ওর জুড়িয়ে যেত। কিন্তু পারলো না সবার সামনে মানিকের জন্য কাঁদতে। কি জন্য কাঁদবে ও, কোন অধিকারে! ওর উপর অধিকারতো রাঙাদাদির আছে, তায় ও কাঁদছে। সবাইকে দেখিয়ে মন খালি করে কাদছে। অন্যেরাও নীরবে চোখের জল মুছছে রাঙাদাদির কান্না দেখে।
মানুষের বাইরের আচরনগুলো যুক্তিতে বাধা, একটু এদিক ওদিক হলে বেমানান লাগে। কিন্তু মনটা একদম স্বাধীন সীমানাবিহীন, কোন বাধন কোন যুক্তি মানে না, খেয়ালী।
নিজের ঘরে এসে জানালা দরজা সব বন্দ করলো শিউলি। নিজেকে নিজের সামনা সামনি দাড় করালো আজ। ওর জীবনে মানিকের অবস্থানটা সঠিক ভাবে নির্ণয়ের জন্য।

মানিকের সাথে ওর পরিচয়টা কয়েকদিনের মাত্র। তাহলে কেন মানিকের জন্য ওর বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
মানুষে মানুষে বাহ্যিক পরিচয়টা দিন ক্ষন বা স্থান দিয়ে বাধা। কিন্তু মনের সাথে মনের পরিচয়টা ঈন্দ্রীয়ের জানালা দিয়ে ঢুকলেও তা সব ঈন্দ্রীয়কে ছাড়িয়ে ভাবনার জগতে প্রবেশ করে। তা হয়ে ওয়ে ওঠে অনন্ত অসীম অনাদি। মানিকের সাথে ওর পরিচয়টা মনের, জন্ম জন্মান্তরের।
মানিক স্বপ্ন দেখে। ওর স্বপ্নগুলো নিজেকে নিয়ে নয় তায় সে স্বপ্নের কোন সীমানা নেই। ও স্বপ্ন দেখে অন্যকে নিয়ে, সব মানুষকে নিয়ে। তায়তো ওকে ধরে রাখা যায় না। ওকে ধরে রাখতে মানা। আর শিউলি ওকে ধরেই বা রাখবে কিসের জোরে। সে রকম শক্তি কোথায় ওর!
যে কোন ভালো কাজে মানিক নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে। নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মধ্যেই যে ওর আনন্দ।
যাওয়ার সময় মানিক ওকে একটু বলে গেল না! একবার শুধু বলতে পারতো ও যাচ্ছে দেশের জন্য প্রাণ দিতে।
কিন্তু একটি বারের জন্য কেন বলে গেল না। একটু অভিমান হলো শিউলির।
নাকি চেষ্টা করেছিল, ওর কাজের চাপ দেখে বা পরিস্থিতি দেখে বলেনি। নাকি বেলালের চলে যাওয়া নিয়ে যা কিছু ঘটলো তা দেখে মানিক চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারিনি।
-নাকি মানিক ভেবেছিলো বললে আমি ওকে যেতে বাধা দিতাম!
শিউলি সবার চোখের আড়ালে নিজের ঘরের জানালা দরজা বন্দ করে মন ভরে কাঁদলো, চিৎকার করে কাঁদলো, যতক্ষন খুশি কাঁদলো। চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেললো কেঁদে কেঁদে।
কতদিন ও কাঁদেনি এমন করে। কান্না যে হৃদয়ের নির্যাস। কার জন্য কাঁদবে, মা মারা যাওয়ার পর ওর জীবনের সব কিছুই যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে। সব কিছুর মধ্যেই হিসাব আর দায়িত্বের গন্ধ। নিরেট বাস্তবতায় ভরা সবকিছু।
বিকেল হয়ে গেছে মনে হলো। একটা জানালা খুলে দিল। বিকেলের ক্লান্ত ঝরঝরে রোদ খিল খিল করে হাসতে হাসতে ওর ঘরে ঢুকলো।
বুক মাথা সবই হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে ইচ্ছা করলে সেও ফুরফুরে বাতাসে পাখা মেলে উড়তে পারবে।
ওর মা মারা গেলে ও বুক খালি করে কেঁদেছিলো, সবার সামনে কেঁদেছিলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে, আপনজনদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো। সে হারানোর ভিতর অধিকার, ভালোবাসা, সমাজ সীকৃতি সবই ছিল।
কিন্তু মানিকের ব্যপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে কোন অধিকার নেই, সামাজিক সীকৃতি নেই, অবৈধ প্রেম নেই।
এ কি অপ্রকাশিত অদেখা বন্ধত্বহীন একতরফা প্রেম! যেমন বাতাসের সাথে ফুলের প্রেম!
শিউলি উঠে দাড়ালো। বিকালের ফুরফুরে বাতাসে জানালার ধারে দাড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। বাথরূমে গেল, হাতে মুখে অনেক্ষন ধরে ঠান্ডা পানির ছিটা দিল।
আয়নাতে নিজের মুখটা চোখে পড়লো। চোখ দুটো লাল আর ফোলা। চোয়াল দুটোও বসে গিয়েছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে জট পাকিয়ে আছে। নিজেকে এ চেহারায় ভারী সুন্দর লাগলো শিউলির।
ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে চোয়ালের উপর লেপটে থাকা চোখের পানির দাগ গুলো মুছতে মুছতে লজ্জায় ওর মুখটা লাল হয়ে গেল। সারা শরীরে রোমাঞ্চ অনুভূত হলো।
যেন নতুন বধুর বাসর যাপনের পরবর্ত্তি লজ্জা রাঙা মুখ!
শিউলি ছাদে গেল। বিকালের ঠান্ডা হাওয়াই চুলগুলো পুরোপুরি খুলে দিল। আজকের বিকালটা ওর কাছে অনন্যসাধারণ এক বিকালের মত লাগলো।
প্রকৃতির সব কিছুই যেমন বাতাসের শন শন শব্দ, গাছের ডালে বাতাসের দোল, পাখীর ডাক সবকিছুই যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো। এই পড়ন্ত বেলায় প্রকৃতির প্রতিটি কাজের মাঝে ও মানিককে অনুভব করতে লাগলো।
মনে হলো প্রকৃতির মত মানিককেও কোন কড়া নিয়ম কানুনের জালে বাধা যায় না, ওকে ধরে রাখতে বেধে রাখতে মানা। ও বাতাসের মত, প্রকৃতির মত নিজ ছন্দে চলে। সবাইকে কেবল দোলা দিয়ে যায়। কোন বাধনই ওকে মানায় না।
একটা পরিপূর্ণতায় ভরে গেল ওর সবকিছু।
এতদিন শিউলি বাধনে অভ্যস্ত ছিল। বাধন খোলার সাহস ওর ছিল না। মুক্ত হাওয়ার স্বাদ ছিল ওর অজানা। নিজেকে চেনার, নিজেকে জানার যে অমৃত তার সন্ধান মানিক ওকে দিয়েছে।

মানিক ফিরে আসলো প্রায় এক মাস পর। ওর এক চাচাতো ভাই ওকে প্রায় বেহুশ অবস্থায় একটা ঘোড়া গাড়ীর উপর শুইয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসলো।
ততোক্ষনে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ওকে গাড়ী থেকে নামিয়ে প্রায় সবার অলক্ষেই নানীর ঘরে উঠালো। নানী সবেমাত্র নামাজ শেষ করেছেন। শোকে মূহ্যমান বৃদ্ধা হতবিহ্বল হয়ে কাঁদতে শুরূ করলেন।
ওর চাচাতো ভাই ঈশারাই নানীকে কাঁন্নাকাটি করতে নিষেধ করলো। সাবধান করে বললো ওকে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে অসুস্থ অবস্থায় আনা হয়েছে। বেশী জানাজানি হলে রাজাকাররা খবর পেলে ওর ক্ষতি হবে। ওর খুব জর, প্রায় অজ্ঞান, মাথায় পানি ঢালতে হবে জর যাতে না বাড়ে। আর গরম দুধ থাকলে খাওয়াতে হবে।
মানিক ওর পাঁচ জন সাথি সহ রাত দশটার দিকে শুরূ করে পরদিন সন্ধ্যায় বর্ডারে পৌছায়। সারারাত সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিল। বর্ডারে একদল বি ডি আর সোলজারদের সাথে দেখা হয়। ভিজা কাপড়ে ওদের সাথে রাত কাটিয়ে পরদিন ওদের ট্রাকে করে ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌছায়।
তখন প্রায় বিকাল, টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিলো। রিক্রটিং অফিসার এসে তাড়াহুড়া করে সবাইকে রিক্রট করে নিল, ওকে বাদে। ও বয়সে কম আর রোগা বলে বাদ পড়ে মানিক। কিছুক্ষনের মধ্যে মানিক দেখে ও একা বাকি সবাই ক্যাম্পের ভিতরে চলে গেছে।
ওর গায়ে ততোক্ষনে জর এসে গেছে। মাথাটা ঘুরে উঠলো, ও মাটিতে বসে পড়লো। তারপর আর কিছু জানে না মানিক।
ঐ অবস্থায় সেণ্ট্রি ওকে গার্ড রূমে নিয়ে শুইয়ে দেয়। যাহোক, পরবর্ত্তিতে ক্যাম্পের ষ্টোর ইন চার্জ যিনি ওর বাবার বন্ধু সে ওকে চিনতে পেরে ওর ষ্টোরের টেণ্টের এক কোনে থাকার জায়গা করে দেয়। সেই ভদ্রলোকের মাধ্যমে খবর পেয়েই ওকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
কথাগুলো বলে ওর চাচাতো ভাই নানীকে সাবধান করে দিল ওর ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার কথা যেন জানাজানি না হয়। এছাড়াও মানিকের খুব একটা বাইরে যাওয়া চলবে না বলেও নানীকে বারবার নিষেধ করলো।
অনেক পিড়াপিড়ি করা সত্বেও ওর ভাইটি ওই রাতেই বেরিয়ে পড়লো। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল আসবে তাদের সাথে আগের প্রোগ্রাম অনুযায়ী যেতে হবে বলে চলে গেল।
সাত রাজার ধণকে ফিরে পেয়ে রোকেয়া বেগম ওকে এমন ভাবে বুকে জড়িয়ে রাখলেন ওখান থেকে যেন কেউ ওকে আর নিয়ে যেতে পারবে না।
কয়েকদিনের মধ্যে মানিক সুস্থ হয়ে উঠলো।
এখন ওর উপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো। সারাক্ষন কেউ না কেউ ওর উপর নজর রাখে। ওর পালিয়ে যাওয়া আর শরীর খারাপের অজুহাতে প্রায় সারাক্ষন ওকে ঘর বন্দী হয়েই থাকতে হয়।