জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' পর্ব -১৭

আপডেট: ২৪ Jul ২০২২, ১৫:৫১

অমৃতের সন্ধানে -১৭ 

 

নানীর ভালবাসার অটুট বাঁধনটা মানিককে আটকে রেখেছে। সে ভালবাসার স্বরূপটা এত ধারালো যে একটুতেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তাইতো মানিক এ মুহূর্তে ওর মনের গভীর চাহিদাকেও নানীর কাছে প্রকাশ করতে পারছে না। নানীর ভালবাসা অবুঝ অন্ধ, কোন যুক্তি তর্কের ধার ধারে না।
অন্য দিকে কি অধিকারেই বা মানিক শিউলিকে বলবে সে কথা। এটাও যে যুক্তির বাইরে। কিন্তু মনের আকুতির শক্তি কোন যুক্তি মানে না। এমনকি তা প্রকাশ করতে ভাষাও লাগে না। যে মন ভালবাসে সে মন না বলতেই সব কিছু বুঝে নেয়।
-তুমি যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য যাও, এবার ঠিকই ওরা তোমাকে নেবে।
শিউলির কথায় মানিক অবাক হয়ে তাঁকিয়ে রইলো তার দিকে।
মানিকের অব্যক্ত ইচ্ছেটা শিউলি বুঝতে পাওয়ায় প্রেক্ষিতে তার দরদ ভরা আশ্বাসে ওর বুকটা হালকা হয়ে গেল। আর সেটা মানিকের দেহভঙ্গিমায় পরিষ্কার পরিস্ফুটিত হয়ে উঠলো।
মানিকের মুখের দিকে তাকিয়ে শিউলির মনে হচ্ছিলো খাচার মুখ খুলতে ব্যর্থ খাচায় বন্দি পাখি কেবল মাত্র খাচার মুখটা খোলা পেয়েছে। এ যেন ওর সহস্র বছরের অপেক্ষার ফল, তায় একটু বিলম্বও ওর কাছে অসহনীয়।
-তুমি চায়লে আজই রওয়ানা হতে পারো, রাঙাদাদি কে আমি সামলাবো।
শিউলির আশ্বাসে আনন্দের অতিশয্যে আত্মহারা হয়ে মানিক ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।
সব শুনে রাঙাদাদিকে কি বলবে তা জানে না শিউলি। এর আগে মানিক চলে গেলে রোকেয়া বেগমের কি পাগলের মত অবস্থা হয়েছিল তা জানে সে।
এত ভরসা কি ভাবে পেল শিউলি? রাঙাদাদির চোখে কি কিছু দেখেছিল সেদিন ও! মনের গভীরে ভাবল সে কথা।
শিউলিকে এভাবে অনেকক্ষন বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলো মানিক। ও যেন শিউলির বুকের সাথে বুক, নিশ্বাসের সাথে নিশ্বাস আর সারা শরীরের সাথে ওর শরীর মিলিয়ে ওর বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা সব অব্যক্ত কথা, সুখ দুঃখ, জ্বালা যন্ত্রনা সবকিছু উজাড় করে দিতে চাইলো।
তাতে একটুও বাধা দিল না শিউলি।
শিউলি বুঝলো মানিক কাঁদছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। যেন বুকের ভিতর দীর্ঘদিন জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে।
-মানিককে তো কাঁদলে চলবে না। কান্না ওকে একদম মানায় না। কাঁদলে ও দুর্বল হয়ে যাবে। তাহলে বন্ধুর পথ চলবে কি করে! ভাবলো শিউলি।
শিউলি ওর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে করতে ওর চোখের জল মুছে দিল। মাথার এলোমেলো চুলগুলো আঙুল দিয়ে একটু ঠিক করে দিল।
নিজের চোখ দুটো মুছতে মুছতে ও বললো - একটু বস আমি আসছি।
-একটু তাড়াতাড়ি করবেন।
-আমাকে আর আপনি বলবে না, কখনো না।
মিষ্টি করে একটু হেসে শিউলি উপরে চলে গেল।

রাত বেশ খানিকটা গড়িয়েছে। জানালা দিয়ে মানিক বাইরে তাকালো। নিকোষ কালো অন্ধকার।
-আলোর ভিতর আছে বলেই বাইরের অন্ধকার অতটা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। ভাবলো মানিক।
শিউলি প্রবেশ করলো। হাতে একটা ব্যাগ, কাপড় ভরা। ওটার দিকে তাকালো মানিক।
-এত কাপড় কি লাগবে? মৃদু হাসলো মানিক।
শিউলি মানিকের চোখে চোখ রাখলো। নির্মল ভালবাসার হাসি।
কিছু কি বলতে চায় মানিক। অপেক্ষা করে রইলো শিউলি।
-এখন রওয়ানা হলে ভোর হতেই সীমানা পার হওয়া যাবে। ধীরে সুস্থে যেতে হবে। রাস্তা অন্ধকার আর পিচ্ছিল।
শিউলি মানিকের মুখের দিকে তাকালো।
একটু থেমে একটা ঢোক গিলে মানিক বললো -বোধহয় বৃষ্টি শুরূ হয়ে যাবে, আকাশ ভরা কালো মেঘ।
দুজনেই চুপ, বাইরে কেবল মেঘ ডাকার শব্দ, বাতাসের ঝাপটা আর থেকে থেকে বিদ্যুতের চমক।
দুজনেই একটু ইতস্ততঃ।
নিস্তব্দতা ভাঙলো মানিক।- রাতের আঁধারে কেউ দেখবেনা, আর রাস্তা তো আমার চেনা।
শিউলি ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
-তোমার এখন যাওয়া দরকার। কথাটা বলতে বলতে শিউলি বাতিটা নিভিয়ে দিল।
হটাৎ অন্ধকার গিলে ফেললো সব কিছুকে। ঘটনার আকস্মিকতাই দুজনই কিছুক্ষন একটু বিহব্বল হয়ে দাড়িয়ে রহলো।
বিহব্বল হয়ে দাড়িয়ে গেলেন রোকেয়া বেগমও।
বেশ রাত হলো কিন্তু মানিক ফিরছে না। তায় তিনি পায়ে পায়ে এদিকে এসেছিলেন। বাইরে দাড়িয়ে তিনি সব দেখলেন এবং শুনলেন।
আলোটা নিভে যাওয়াই আর কিছু দেখা গেল না। কোন কথাও কেউ বলছে না। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। কিছু খস খস আর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলেন না রোকেয়া বেগম।
বাইরে নিকোষ কালো অন্ধকার আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ঝড়ো হাওয়ার মাতামাতি।
ওরা দুজন বেরিয়ে এলো, ব্যাগটা মানিকের হাতে ধরা। উচু বারান্দার সিড়ি বেয়ে নেমে একটু দাড়ালো ওরা। মানিক একটু সামনে।
হটাৎ বিদ্যুতের ঝলকানিতে ওরা দেখলো অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকা রোকেয়া বেগম। থমকে দাড়ালো দুজনেই।
তিনটি প্রাণী বিহব্বলতার আতিসয্যে স্তম্ভিত, বাকরূদ্ধ। কেউ কাউকে কিছু বললো না।
আকাশে মেঘের গোঙরানি, ঝাপটা বাতাসের গতি বেড়েই চললো। আকাশের বুক চিরে সব অন্ধকারকে দূরে ঠেলে বিদ্যুৎ চমকালো।
ওরা একে অপরকে ভালো ভাবে দেখে নিল।
পরোক্ষনেই নিকোষ কালো অন্ধকার সব গিলে ফেলে সবকিছু একাকার করে দিল।
নিমেষের মধ্যে অন্ধকারে মানিক মিলিয়ে গেল।
রোকেয়া বেগম নিঃশব্দে এগিয়ে শিউলির কাছে এসে দাড়ালেন।
-মানিক চলে গেল! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা বললেন রোকেয়া বেগম।
- দেখলেই যখন তখন তুমি ওকে বাধা দিলে না কেন! ডুকরে কেঁদে উঠে কথাটা বলতে বলতে ও রাঙাদাদির বুকে মুখ লুকালো।
রোকেয়া বেগম স্বস্নেহে ওকে বুকে টেনে নিয়ে ওর মাথায় শান্তনার হাত বুলাতে লাগলেন।
ওরা দিঘির সিড়িটার উপর গিয়ে বসলো।
এই আন্ধকার ঝড়ো আবহাওয়াই প্রায় মাঝ রাতে এই দুটি অসম বয়সী রমণী একজন ভালবাসার মানুষের জন্য নীরবে অশ্রুবন্যায় বদন ভেজাতে লাগলো। মাতৃ হারা মানিককে রোকেয়া বেগম মায়ের স্নেহে আটকিয়ে রাখতে চান, কিন্তু শিউলির ভালবাসার প্রকৃত কোন নাম নেই, শ্রেনী নেই, দায় দায়িত্ব নেই। হারানোর কোন ভয় নেই, কোন প্রতিদ্বন্দি নেই, নেই কোন প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা।
- মানিককে বাধা যায় না রাঙাদাদি। সব বাধনেই ওর অনীহা। বাধনে ওকে মানায় না। বাধনে ওর দম বন্দ হওয়ার উপক্রম হয়।
রোকেয়া বেগম নিঃশব্দে শিউলির মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
-মানিক চলে গেল। আবার কখনো দেখা হবে কিনা জানি না। হয়তো হবে না, কিন্তু ও আমাকে যা দিয়েছে তা দিয়ে বাকি জীবনটা অনায়াসেই চলে যাবে। এর থেকে বেশি ধারন করার মত ক্ষমতা আমার নেই। আমি জানি ও আমার কথা ভুলে যাবে, কখনও খোজও হয়তো করবে না। তবে ওকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়, আর আমি ভুলতেও চায় না ওকে।
শিউলি রাঙাদাদির কোলে মাথা রেখে ভাবছিলো।
-মানিকে ভুলা যায় না রাঙাদাদি।
কথাগুলো নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে বলতে বলতে শিউলি ডুকরে কেঁদে উঠলো। রোকেয়া বেগম স্বস্নেহে ওকে বুকে টেনে নিলেন।
-মানিকের মধ্যে অন্য রকম আকর্ষণ শক্তি আছে। সে আকর্ষণের বলয়ের মধ্যে একবার কেউ আসলে সে বাঁধন ছেড়া যায় না। কিন্তু ওকে ধরা যায় না, ছোয়া যায় না, কোন বাধনে ওকে বাঁধা যায় না। সকালে সন্ধ্যাই কাজের ফাঁকে বা কাজের মধ্যে মানিককে নিয়ে আমি ভাববো। আনন্দ বেদনায় মেশানো জীবনের প্রতি মুহুর্তে থাকবে ও আমার চিন্তা চেতনায়। ওর দেয়া ভালবাসার নির্যাস দূর থেকে গ্রহন করেই তৃপ্ত থাকতে হয়। জানিনা, হয়তো স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বা সন্তানকে আদর করতে করতে আনমনে ওর কথা ভাববো।
রোকেয়া বেগমের স্নেহের পরশে তার বুকে মুখ লুকিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল শিউলি।


Read More