জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'দিব্য দর্শন'।

আপডেট: 2022-09-27 11:48:50

দিব্য দর্শন

 


একটা ভূমিকম্প প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে বহুতল ভবনের ভিতটা নড়িয়ে দিলে যেমন সে ঘরে আর বসবাস করা যায়না, ঠিক তেমনি একটা ঘটনা সারা জীবন ধরে অতি যত্নে গড়া অমরের জীবনের ভিতটাও নড়বড়ে করে দিল।
এ যাবত লালিত জীবনের অর্থটা এলোমেলো হয়ে সেটা আবার নতুন করে খুঁজে দেখার তাড়না ভীষণভাবে অনুভব করতে লাগল পড়ন্ত বয়সী অমর।
ধাক্কাটা আর্থিক নয় যে মেরামত করে বা ভেঙ্গে আবার গড়া যাবে। সেটা সম্পূর্ণ মানসিক, আত্মিক, যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না এমনকি সবাইকে বলাও যায় না। আর যার যাকে বলা যেত সে সহযাত্রী মানুষটি বছর পাচেক আগে সন্তানদের হাসিমুখ দেখে ইহলোকের সব মায়া কাটিয়ে পরপারে গমন করেছে।

কোন শিশু আঘাত প্রাপ্ত হলে দৌড়ে মায়ের কোলে আশ্রয় নেয়। ব্যথাটা যেহেতু শারীরিক, মা আঘাতের জায়গাটাতে ওষুধ লাগিয়ে, আদর করে সে ব্যথা উপশম করে দেয়। শিশু বয়েসের একটা বাড়তি সুবিধা আছে, ব্যথা উপশম হলে শিশু তা ভুলে যায়। সে বয়সে কোন ব্যথা শরীর ভেদ করে মন বা অন্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।
অমর জন্মেই মাকে হারিয়ে সে সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। মায়ের কোন স্মৃতিই ওর নেই বললে চলে। বাবাও গত হয়েছেন তাও অনেক বছর হল। অমর এখন নিজেই বার্ধক্যে পৌঁছেছে। কিন্তু বাবার সব স্মৃতি ওর মানস্পটে গভীর ভাবে গেঁথে আছে। মাকে হারানোর পর মা বাবা দুজনেরই অভাব মিটিয়ে বাবাই ওকে মানুষ করে তুলেছে।
বাবার সে সব স্মৃতি ওর পিতৃ পুরুষের ভিটেতেই লুকিয়ে আছে।
অমর আজ তার নিজের হাতে গড়া নড়বড়ে হয়ে যাওয়া নিজ ভুবন ছেড়ে একদম উৎপত্তির কাছে ফিরে এসেছে।

অমরের পরদাদার হাতে তৈরি প্রায় দশ একর জমির উপর ওদের ভিটে বাড়ীটা। কালে কালে শহরের সাথে মিশে গেলেও এখনো সেখানে প্রকৃতি আছে, নিস্তব্ধতা আছে।
সব রেখে তিনি অকালেই চলে গেলেন। তার একমাত্র ছেলে, অমরের দাদা যেন চোখে সরষের ফুল দেখতে শুরু করলেন। তারপর অনেক চড়াই উতরাই পার করতে ক্লান্ত হয়ে তার একমাত্র ছেলে অর্থাৎ অমরের বাবাকে কোন রকমে জীবনের পথে ঠেলে দিয়ে তিনিও চোখ বুজেছিলেন।

দীর্ঘদিন মেরামতের অভাবে রং চটা আর অধিকাংশ জায়গা খসে পড়া কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সে পিতৃ পুরুষের বাড়ীতেই উঠেছে অমর। কেউ থাকেনা বলতে গেলে চলে। বাবা বেচে থাকতে তিনি অমরের বয়সি এক অনাথ ছেলেকে এনেছিলেন এ বাড়ীতে। সে আর এ বাড়ী ছেড়ে যায়নি। মেরু মিয়া তার নাম, সেই সব দেখাশোনা করে রাখে।
জীবনের অর্থ নতুন করে খোঁজার প্রয়াসে উৎপত্তির কাছাকাছি এসেছে অমর।

মূল বসত বাড়ীর সামনে চারদিক উঁচু করে পাড় বাধানো বিশাল একটা দীঘি। সে দীঘিরই উত্তর পাড়ের উপর দাঁড়ানো সামনে প্রশস্ত বারান্দা ওয়ালা একটা কাচারি ঘর। বারান্দায় বসলে দীঘির টলমলে পানি আর ওপারে দিগন্ত জোড়া সবুজ ধানের ক্ষেত চোখে পড়ে।
কাচারি ঘরের বারান্দায় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে নিজের মধ্যে ডুবে থেকে দিন কাটিয়ে দেয় অমর।
জীবন আর পার্থিবতা নিয়ে একদম ভাবতে চায় না অমর। এ বয়েসে এসে সে বুঝেছে দুনিয়াটা খুব নির্মম বাস্তব, চাকচিক্যে ভরা। সময়ের কাছে পরাভূত হয়ে কালে কালে উপরের সব চাকচিক্য হারিয়ে গেলে আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্তঃসারশূন্য আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে। যা খুব কদর্য। সেটা শারীরিক কোন কিছু হোক বা ভালবাসা।

সেদিন সকাল থেকেই শ্রাবনের বৃষ্টি অঝরে ঝরতে শুরু করেছে। কাচারি ঘরের বারান্দায় ইজি চেয়ারে গাটা এলিয়ে দিল অমর। চোখ দুটো এমনিতেই বন্দ হয়ে আসলো।
বাবার কথা খুব মনে হতে লাগলো অমরের। বাবা ছিলেন ওর দাদার একমাত্র সন্তান। ছেলের পড়াশোনা চলা কালে তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ওর দাদা যাতে ছেলে তাড়াতাড়ি সংসারী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু দাদার অকাল মৃত্যুর পর ওর বাবা পড়াশোনা বন্দ করে মফঃস্বল শহরে নিন্ম পদে একটা সরকারী চাকরী নিয়ে সে ইনকাম আর জমির ফসল থেকে আয় রোজগার দিয়ে সংসারটা চালাতে শুরু করেন।
সে আয় রোজগারে পিঠা পিঠি অনেকগুলো ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার দিয়ে বাচিয়ে রাখা ছাড়া আর তেমন কোন চাহিদা পূরণের সামর্থ্য বাবার ছিল না বাবার।
বাল্যকালে কাচারি ঘরটার সাথে লাগোয়া মাঠে ওরা খেলাধুলা রত থাকা অবস্থায় অমর যখন দেখত বাবা ক্লান্ত দেহে সাইকেলে প্যাডেল মেরে প্রায় চার মাইল দূরে অবস্থিত শহর থেকে অফিস শেষে বাড়িতে ফিরছে, বাবাকে তখন খুব অবসন্ন দেখাতো। অমরের মনে হত বাবার কাছে যেয়ে তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করুক কিন্তু কখনও তা হয়ে ওঠেনি।
চোখে চোখ পড়লে বাবা বলতেন –যাও, সন্ধ্যে হয়ে এলো, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। ভাল করে পড়াশোনা করবে। কথাটা বলে বাবা একটু হাসার চেষ্টা করতেন।
বাবার শুঁখনো মুখে জোর করে টানা সে হাসি খুব বেমানান লাগত।
ছুটির দিন বাবা বাড়ীর নানা কাজে ব্যস্ত থাকতেন। আর ফাঁক পেলে কাচারি ঘরের বারান্দায় এসে ইজি চেয়ারটাতে গাটা এলিয়ে দিতেন। খুব অসহায় দেখাত বাবাকে। অনেকটা দিক হারানো কুল কিনারা বিহীন অথৈই জলের মাঝখানে হাল ছেড়ে দেয়া ভাঙ্গা নৌকার মাঝির মত। তিনিই দাড় মাঝি, তিনিই হাল মাঝি।
যৌবনের প্রারম্ভে প্রথম বিয়েটা করেছিলেন বাবা। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় তার স্ত্রী মারা যায়। তার পর বেশ কয়েক বছর পর তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করেন। সে স্ত্রীও ষষ্ট সন্তানের জন্ম দেয়ার সময় মৃত্যু বরন করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাবালোক বাচ্চাদের মানুষ করার জন্য তাঁকে তৃতীয় বিয়ে করতে হয়।
বলতে গেলে অপরিণত বয়সে পিতৃহীন হয়ে সংসার নামের ঘানিটা কাধে তুলে নিয়েছিলেন বাবা। তারপর একটার পর একটা দুর্ঘটনা তাকে জর্জরিত করতে থাকে। কিন্তু নিজের কষ্ট দুঃখ প্রকাশ করার মত নিজের কোন ভাই বোন বা আপন কেউ তার ছিল না বাবার। আর ছেলে মেয়েরাও সবাই ছোট ছোট।

আজ বাবার কথা ভাবতে যেয়ে অমরের মনে হতে লাগলো –খোদা তাঁর ক্ষমতা পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে বোধহয় তার বাবাকে বেছে নিয়েছিলেন!

প্রাচুর্যে ভরা সংসারে বড় হওয়া অমরের ছেলে মেয়েরা যে যার জীবনে প্রতিষ্ঠিত। তারা নিজেদের মত করে নিজেদের পছন্দের জায়গায় বসবাস করছে। তাদের তরফ থেকে কিছু অবহেলা অমরের এতকাল লালিত জীবনের অর্থটা এলোমেলো করে দিয়েছে।

প্রাচুর্যের সংসার অমরের, তা সত্ত্বেও ছেলে মেয়েদের অনেক আবদার রক্ষা করতে না পারার অসামর্থ্যতা অমরকে এখনো পীড়া দেয়। সে বিচারে টানাটানির সংসারে সন্তানদের আবদার রক্ষা করতে না পারার অসামর্থ্যতার জন্য ওর বাবার কষ্টের কথা অনুধাবন করে অমরের দু চোখ বয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
অমরের বাবা প্রকৃত অর্থে ওদের ভাই বোনদের জীবনের অতিরিক্ত কোন চাহিদায় পূরণ করতে পারেননি। কিন্তু ছোট কালে বাবার এহেন আচরণ কখনো তার অসামর্থ্যতা মনে হয়নি অমরের কাছে। মনে হত, বাবা ইচ্ছে করলে সব দিতে পারে, ওদের সব চাহিদায় পূর্ণ করতে পারে। কিন্তু তিনি সন্তানদের কোন ভালোর কথা চিন্তা করে সেগুলো দেয় না।
বাবা পারে না এমন কোন বিষয় আছে বলে অমরের ধরনার বাইরে ছিল। বাবা ছিল অমরের কাছে যাদুকরের মত, যে কোন সমস্যার সমাধান তিনি দিতে পারতেন। নতুন জামা প্যান্ট কিনে দেয়ার বাহানা করলে বাবার নীরব চাহনি অমরের সব চাহিদা মিটিয়ে দিত।
এখন ভাবে –কি ছিল বাবার সে চাহনিতে! অসহায়ত্বের যন্ত্রণা না অন্য কিছু?

কিন্তু আজ তার নিজের জীবনে এ সব কেন ঘটছে! জীবন সমুদ্র পার হয়ে তীরে কেন জাহাজটা ভিড়াতে পারছে না।
-আমাকে আমার স্বপ্ন পূরণ না করতে দিয়ে আমার মাধ্যমে তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছ তুমি! এখনও উপদেশ দিয়ে দিয়ে আমার জীবনটাকে তোমার মত করে কেন চালাতে চায়ছো বাবা?
সন্তানের এ মন্তব্যের কথা কাকে বলবে অমর! তাইতো সব ছেড়ে ছুটে এসেছে বাবার কাছে।

বেলা এখনো ডুবার কিছুটা বাকি। কিন্তু আকাশটা মেঘে ঢেকে ফেলে বেলা থাকতেও অন্ধকার নেমে এসেছে। শ্রাবণের অবিরাম ঝরতে থাকা বৃষ্টির শব্দ অন্য সব কোলাহল কে ছাপিয়ে দিয়েছে।
হটাৎ করেই অমরের মনে হল আলো আধারির ঢাকনা ভেদ করে কে একজন ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। পাচ ফুটের একটু উপরে উচ্চতা, গায়ে কিছুটা মেদ জমেছে, মুখ ভর্তি দাড়ি, অন্ধকারে ভাল ভাবে না বোঝা গেলেও মনে হচ্ছে ময়লা গায়ের রং।
তাঁকে খুবই চেনা মনে হল অমরের। কিন্তু কিছুতেই স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তার পরিচয় বের করতে পারল না। তবে তাঁর উপস্থিতি অমরের সারা যন্ত্রণা দূরীভূত করে ওর দেহ মনে প্রশান্তি এনে দিল।
হাস্যজ্জল মুখটা। খুবই চেনা লাগলো অমরের।
ছোট কালের কিছু ভাবনা অমরের হৃদয়ে গেথে আছে। ওর মন খারাপ হলে বা মনে কোন কষ্ট লাগলে নিজের মত করে নীরবে এই কাচারি ঘরের বারান্দায় বসে খোদাকে স্মরণ করে ওর কষ্টের কথা বলতে চাইতো। খোদার চিন্তাই বার বার ওর মানসপটে তখন বাবার চেহারাটাই ভেসে উঠত। সে থেকেই ওর শিশু মনে ওর বাবার আদলে অদেখা খোদার একটা অবয়ব তৈরী হয়েছিল। আর তাঁর কাছে মনের যত কথা বলে মনটা হালকা করে বাড়ী ফিরত অমর।
আজ হটাৎ করে মনে মনে হল ওর বাবার চেহারা ধরে স্বয়ং খোদা ওর সামনে হাজির হয়েছে। এ যে দিব্য দর্শন!
এলোমেলো হয়ে যাওয়া এ জীবনের অর্থ সম্পর্কে নীরব ভাষায় জিজ্ঞেস করল অমর।
বাবা ওর গায়ে হাত রাখলেন। তাঁর স্পর্শ সব বেদনা ভুলিয়ে অমরের দেহ মন এক স্বর্গীয় আনন্দে উদ্বেলিত করলো।
আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকাল। তাতে বাবার মুখটা পরিষ্কার ভাবে দেখল অমর। ওর কোন আবদার রক্ষা করতে না পারলে বাবার মুখের উপর যে হাসিটা ফুটে উঠত ঠিক তেমনি হাসিতে ভরা বাবার মুখ। সে হাসির স্বরূপটা তখনকার মত এখনো না বুঝলেও ওর উত্তর খুঁজে না পাওয়া পিপাসিত অন্তরটা জুড়িয়ে গেল।
একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে ওর চোখে মুখে লাগলো।
-একমাত্র মৃত্যুই এ সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে।
কোন কথা নয়, কথার ভাবটা ওর অন্তরাত্মা পরিষ্কার শুনতে পেল।
পরদিন সকালে মেরু মিয়ার ডাকাডাকিতে মানুষ এসে অমরের নিষ্প্রাণ দেহটা উঠিয়ে সমাধিস্ত করার ব্যাবস্থা করল।