জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'স্টেশানের সিগন্যাল ম্যান'।

আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ১৪:২৯

স্টেশানের সিগন্যাল ম্যান

 

শহর থেকে মাইল পাচেক দূরে অবস্থিত একটা ছোট রেল স্টেশানের সাথে লাগোয়া ওদের গ্রামটা। স্কুলের লম্বা ছুটি তেমন কিছু করার নেই তাই পলাশ তার কয়েক বন্ধু মিলে সেই রেল স্টেশানের বেঞ্চে বসে গল্প গুজব করে সময় কাটাচ্ছিল।
হটাৎ একটা মেইল ট্রেন এসে থেমে গেল, যেটা এই ছোট স্টেশানে থামার কথা না।
ওরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
তারপর বলা যায় অনেকটা স্বজ্ঞাবলে ওরা দৌড়ে উঠে পড়ল মেইল ট্রেনটাতে।
অজানা গন্তব্যে যাত্রার মধ্যে একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার আছে যেটা পলাশকে চিরকাল আকর্ষণ করে। ট্রেনে উঠে ওরা তিন বন্ধু অল্প কথায় নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিল যে টিটি’র দিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে তাকে এড়িয়ে চলা যায়। না হলে আক্কেল সেলামি গুনতে হবে আর জেলেও যেতে হতে পারে।
মাঠ ঘাট আর ছোট ছোট সব স্টেশান পেরিয়ে ট্রেনটা ছুটে চলল। সকালে উঠেছে আর তখন প্রায় দুপুর পেরিয়ে গেল, গল্প গুজব আর টিটি’র সাথে লুকোচুরি করে মাজার সময় কাটলো তিন বন্ধুর। এক এক জন পালা করে টিটি’র উপর নজর রেখে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে নিচ্ছিল ওরা।
কি ভাগ্য, ক্লিয়ারেন্স না পাওয়াই ট্রেনটা আবারো একটা ছোট স্টেশানে থেমে পড়লো। যাত্রীরা সবাই বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলো।
-আর কত বার থামবে এই ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ার জন্য।
-যতদিন ডাবল লাইন না হবে ততদিন এ ভোগান্তি পোহাতে হবে।
একজন যাত্রীর বিরক্তি প্রকাশের জবাবে অন্য একজন যাত্রী মন্তব্য করল।
ছোট্ট একটা স্টেশান দেখা যাচ্ছে। মেইল ট্রেনটা মুল প্লাটফর্ম ছেড়ে সাইড লাইনে দাড়িয়েছে।
ওরা তিন বন্ধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিয়ে নেমে পড়ল।
স্টেশানের পিছনে ছোট একটা বাজার। সবারই পেটে ক্ষুধা। ওরা বাজারের একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুপুরে কিছু একটু খেয়ে নেয়ার মনস্ত করল।
এই প্রথম ওরা কার কাছে কত টাকা আছে সেটা মিলিয়ে দেখার তাড়া অনুভব করল।
সব মিলে যা হল আপাতত তা দিয়েই ওরা কিছু খেয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করল।
খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে বেলা দুটো বাজলো। ওরা ঠিক করল এবার ফিরতে হবে। স্টেশানে জিজ্ঞেস করে জানলো পর দিন দুপুরের আগে কোন ফিরতি ট্রেন এখানে থামবে না।
সবার মাথাই হাত। সব বুদ্ধি যেন ফুরিয়ে গেল।
-পকেটে কোন পয়সা নেই, কাল দুপুরের আগে কোন ট্রেন নেই। রাতে কোথায় থাকবো, কি খাব তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। বেশ মজার ব্যাপার না?
পলাশের এমন হালকা মন্তব্যে বাকি দুজন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। দুজনের কেউই পলাশের মজা করা মন্তব্যে যোগ দিল না।
-আরে শোন, আমরা তো জানি যে এখন কারো কিছু করার নেই। না কি?
ওরা বাকি দুই বন্ধু ‘হ্যে’ সুচক অবয়বে পলাশের দিকে তাকাল।
-ফেরার জন্য যদি কিছু ঘটে তবে সেটা কালকের আগে না।
ওরা পলাশের ঠান্ডা মাথাই এ রকম একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে শান্ত ভাবে কথা বলার ধরণে অবাকই হল। যদিও পলাশের এ ধরনের স্বভাব সম্পর্কে ওরা জানে কিছুটা, তবুও এ পরিস্থিতিতে পলাশ কোন পথ বের করতে পারবে বলে ওদের বিশ্বাস হল না।
-ইয়ার্কি না করে ভাব কি করা যায়?
-এতক্ষণে তুই বুদ্ধিমানের মত একটা কথা বলেচিস। কিন্তু মনে এত ভয় থাকলে ভাল ভাবে কি করে ভাববি? বল্টুর মন্তব্যের জবাবে পলাশ বলল।
-রাতে কি খাব, কোথায় থাকব তার কোন ঠিক নেই আর তুই বলছিস ভয় না পেতে!
-শোন শোন, ভয় পেলে কি সমস্যার সমাধান হবে! তার থেকে আয় এই নতুন জায়গায় নতুন মানুষের সাথে পরিচয় করার চেষ্টা করি, একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। আরে বন্ধু পথে যখন নেমেছি তখন পথই পথের সন্ধান দেবে।
পলাশের কন্ঠ থেকে আত্মবিশ্বাস যেন ঠিকরে পড়ল।
তিন জনের মধ্যে লাল্টু একটু বেশী ভিতু, ওর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ওর মনে জোর আনার জন্য কথাগুলো বলল পলাশ।
-চিন্তা করিস কেন এত, কেবল মাত্র দুপুর গড়াল, রাত হতে অনেকটা বাকি। রাত হলেই না রাতের খাবার আর ঘুমানোর প্রশ্ন আসবে। তার আগ পর্যন্ত সময় টুকু চল আনন্দ করি। আনন্দ করতেই তো আমরা এসেছি। না কি?
পলাশের কথাই বাকি দুই বন্ধু শুখনো মুখে অসহায়ের মত মাথা ঝাঁকিয়ে সাই দিল।
-বুদ্ধির জোরে টিকিট না কেটে এত দূর ভ্রমন করলাম, আর কি ভাবে এত দূর পর্যন্ত টিটি’র চোখ ফাঁকি দিলাম, ভাবতো।
পলাশের মন্তব্যে তিন বন্ধুই হেসে উঠলো।
-আরে তোরা তো জানিস নে, টিটি’র কাছে আর একটু হলেই আমি ধরা পড়তাম।
লাল্টুর কথায় সবাই ওর দিকে তাকাল।
টিটি আমার কাছে আসতেই আমি তাড়াতাড়ি নিজের পেট টিপতে টিপতে তাকে সালাম দিয়ে –আঙ্কেল টইলেট কোন দিকে জিজ্ঞেস করতে তিনি আমার দিকে একটু তাকিয়ে তিনি ঈশারাই টইলেট দেখিয়ে দিলেন।
লাল্টুর কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

-কি বাবারা তোমরা কোথা থেকে এসেছ, আর যাবেই বা কোথায়? বেশ কিছুক্ষন ধরে দেখছি বেঞ্ছে বসে গল্প করছ।
রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টের লিভারি পরা আধা বয়সী ভদ্রলোক কখন ওদের এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে ওরা কেউ খেয়ালই করেনি।
ওরা তাড়াতাড়ি উঠে দাড়াল। ভাবল, তিনি ওদের টিকিট ফাঁকি দেয়ার কথাগুলো শুনে ফেলেছে কিনা?
-হ্যে আঙ্কেল, আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি। পলাশ জবাব দিল।
-কোথায় পড় তোমারা?
পলাশ ওদের স্কুলের নাম বলে ওরা তিন জনই একই সাথে পড়ে বলে জানাল।
-তা এখানে কোখায় এসেছ?
-কোথাও না, মানে এমনি বেড়াতে এসেছি।
ভদ্রলোক বেশ উৎসুক হয়ে উঠলেন।
লাল্টু বড় একটা ঢোক গিলে বড় বড় করে ওদের এখানে আসার আর এখানে নামার ব্যাপারটি সংক্ষেপে বলে দিল।
-তাই বল। এস আমার সাথে। মৃদু হেসে কথাটা বললেন সে ভদ্রলোক।
লোকটির চালচলন আর কথা বলা ইত্যাদি ওদের মনে একটা অজানা আশার সঞ্চার করল।
নিজেকে স্টেশানের সিগন্যাল ম্যান পরিচয় দিয়ে তিনি ওদেরকে তার অফিসে নিয়ে বসালেন।
-তার অর্থ দাঁড়াল, নিজেদেরকে সাহায্য করার কোন সামর্থ্য এখন তোমাদের নেই।
সবাই তাকাল সিগন্যাল ম্যানের দিকে। মৃদু হাসিতে ভরা মুখ, যেন আগে থেকে জানত সব।
-তাহলে আর চিন্তা করে লাভ কি?
সেই হাসিটা লেগে তার মুখে চোখে।
তিনি পাশের দোকান থেকে কলা আর বোন রুটি এনে ওদেরকে খেতে দিলেন।
-নাও খাও, ততোক্ষণে আমি হাতের কিছু কাজ সেরে নিই। আপাতত রাতের খাবার আর থাকার বন্দোবস্তের দরকার, কি বল? আরে চিন্তা কোর না, সে সময় আসতে এখনো বাকি আছে।
তিনি কিছু খাতা লিখতে লিখতে কথাগুলো বলছিলেন।
পাচ ফুট ছ ইঞ্চির মত লম্বা, ছিপছিপে শরীরের গড়ন, যাকে বলে একদম মেদহীন, লম্বা সরু নাক, চোখে পুরু লেন্সের চশমা পরা আধা বয়স পার করা লোকটি। তার হাসি লেগে থাকা মুখটা দেখলে মনে হয় কত দিনের চেনা।
-চল যায় একটু ঘুরে দেখি, আমার কাজ আপাতত শেষ।
হাতের কাজ শেষ করে তিনি বললেন।
তাকে অনুসরণ করে ওরা ছইয়ের মত আধা বৃত্তাকার কাঠামোর উপর চট আর পলিথিনের ছাউনি দেয়া গোটা পঞ্চাশেক ঘরের ঘন বসতিপূর্ণ একটা ছোট বস্তি এলাকার মধ্যে ঢুকল। পড়ন্ত বিকেল, বস্তির পিছনে এক চিলতে মাঠ সেখানে গোটা বিশেক ছেলে ফুটবল খেলছে। সিগন্যাল ম্যানকে দেখে খেলা থামিয়ে সবাই ছুটে আসলো।
তিনি তাদের সবাইকে পকেট থেকে বের করে একটা করে চকলেট দিলেন। ওদের তিন বন্ধুকেও দিলেন।
-এরা তিন জন তোমাদের নতুন বন্ধু, এদেরকে নিয়ে যাও খেলা কর। খেলার পর কি করতে হবে মনে আছে তো?
-হ্যা আছে। ছেলেরা সবাই সমস্বরে বলে উঠলো।
ওরা তিন বন্ধু সম বয়সীদের সাথে খেলাই মেতে উঠে সব ভুলে গেল।
সন্ধ্যার একটু আগে খেলা শেষ করে বস্তির ভিতর ঢুকল সবাই। ততোক্ষণে দিনের কাজ শেষে বস্তিবাসীরা ফিরতে শুরু করেছে।
ছেলেরা সবাই মিলে ভাগা ভাগি করে বস্তির কয়েকটা ঘরের ছেড়া চট আর পলিথিনের ছাউনি সরিয়ে পাশে রাখা নতুন পলিথিন তার উপর বিছিয়ে টেনেটুনে বেধে ঠিকঠাক করে দিয়ে আনন্দ করতে করতে চলে গেল।
সিগন্যাল ম্যান হাসি মুখে ওদের তিন বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল।
-এতিম খানার ছেলেগুলো অন্যকে নিঃস্বার্থ ভাবে সেবা দিয়ে ওদের আশ্রয়ে চলে গেল। নিঃস্বার্থ সেবা মনে এক স্বর্গীয় অনুভব যোগায়। এখন চল আমরা আমাদের আশ্রয়ে যায়।
তাকে অনুসরণ করে তিন বন্ধু স্টেশানের পিছনে এক কামরার একটা স্টেশানের সরকারী কোয়াটারে প্রবেশ করল।
রুমটা বেশ প্রশস্ত, ভিতরে একটা চওড়া খাট, দুটো কাঠের চেয়ার আর একটা আলমারি।
-তোমরা সামনের চাপ কল থেকে হাত মুখ ধুয়ে বস।
কথাটা বলে তিনি পিছনের দিকে আলাদা করে টিনের ছাপড়া দিয়ে তৈরী রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন।
সে রাতে ভাত ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে রাতের খাবার ওরা সবাই তৃপ্তি করে খেল।
সিগন্যাল ম্যান এক কাপ চা হাতে নিয়ে খাটে বসে দেয়ালে হেলান দিলেন।
-জীবন কেবল শুরু তোমাদের। প্রতিটি জীবন কোন না কোন সময় কানা গলিতে এসে ঠেকে যায়। তখন অনেক চেষ্টার পরও যখন মনে হবে কোন পথ নেই, ঠিক তখনি কোন দিশারি পথের সন্ধান নিয়ে আসবে। নিরাশ হবে না কখনো। আর সমস্যা জর্জরিত মনটা যখন ব্যথাই ভরে যাবে তখন সমস্যাই পড়া আশে পাশের কাউকে সাহায্য করবে। দেখবে মনে জোর ফিরে পাবে আর সব হারিয়ে তোমার যে টুকু অবশিষ্ট আছে তার জন্য মনের ভিতর কৃতজ্ঞতা বোধ আসবে।
তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথাগুলো বলছিলেন।
-অনেকটা মাঝ দরিয়াই পথহারা দাড় ভাঙ্গা ক্লান্ত মাঝির মত। যখন পুরোপুরি নিরুপায় তখন যদি মাঝি পালটা উচু করে বেঁধে তীরের কথা চিন্তা করে, তখনই পালে বাতাস লাগে।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘুম ঘুম চোখে খাটের উপর গা এলিয়ে দিয়ে ওরা সিগন্যাল ম্যানের কথা শুনছিল।
-তবে হ্যে, বাতাস খেয়াল করে তার সাথে সমন্বয় করে পালটা কিন্তু বিন্যস্ত করে নিতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে তুমি আশা হারিয়ে ফেলনি।
-সব কিছুই মেনে নিয়ে মানিয়ে নিতে হবে। প্রথমে পরিস্থিতিকে পাল্টিয়ে নিজের পছন্দের সাথে মিলিয়ে নেবে না হলে নিজেকে পাল্টিয়ে নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে।
সিগন্যাল ম্যান চায়ে একটা চুমুক দিয়ে নিলেন।
-তোমরা নবীন, এখন আমার সব কথা না বুঝলেও বড় হয়ে কখনো না কখনো নিশ্চয় আমার কথা মনে পড়বে।
সিগন্যাল ম্যানের কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই ওরা ঘুমিয়ে পড়ল।
বেশ ভোরে সিগন্যাল ম্যানের ডাকে জেগে উঠে তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে তার পিছে পিছে স্টেশানের প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালো ওরা। সিগন্যাল ম্যান লাইনের দিকে তাকিয়ে দেখল যতদূর দৃষ্টি যায়।
প্রায় তখনি একটা মেইল ট্রেন ক্লিয়ারেন্স না পেয়ে থেমে গেল। সিগন্যাল ম্যানের হাসিমাখা চোখের ইশারায় ওরা তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠার জন্য পা বাড়াল। ঠিক তখনি কেউ কিছু বুঝে উঠার আগে সিগন্যাল ম্যান পলাশের বুক পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন।
সিগন্যাল ম্যান প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তার হাতের সবুজ রঙের পতাকা উড়িয়ে ক্লিয়ারেন্স দিলেই ট্রেনটা ওদেরকে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে চলতে শুরু করল।