জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -২৪ (শেষ পরব)।

আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৫০

জীবনের অন্যপিঠ- ২৪ (শেষ পর্ব)  

 

হটাৎ করে ফুসলে ওঠা প্রকৃতির তান্ডবের কান্ড সব দেখে শুনে বেশ একটু রাতে ফিরে আসলো অমর, অনিরুদ্ধ আর রামদয়ালকে নিয়ে।
প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে কাচারি ঘরের বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলেন নীলিমা চৌধুরী।
ওদেরও চোখে মুখে বেদনার রেখা সুস্পষ্ট।
-অনেক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে মানুষের। ওদের পাশে এখন দাড়াতে হবে।
অমর মাকে দেখে কথাটা বলল।
-আমার এখন যাওয়া হবে না। কি করে যাব এ সব ছেড়ে! আবার যে সব নতুন করে শুরূ করতে হবে মা।
অমরের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন নীলিমা চৌধুরী। কিছু বললেন না।
-আমারও যাওয়া হবে না। কি যে সব হলো হটাৎ করে!
কিছুটা নির্লিপ্তভাবে বললো অনিরূদ্ধ।
ওদের দুজনের কথা শুনে পাশে নীরবে দাঁড়ানো রামদয়ালের মুখের দিকে গভীর ভাবে তাকালেন নীলিমা চৌধুরী।
আবেগের কোন বহিঃপ্রকাশ একদম পরিলক্ষিত হল না রামদয়ালের চোখে মুখে। একটি কথাও বলল না সে। যেন সবই জানতো আগে থেকেই।
-সারাদিন তো কারো কিছু খাওয়া হয়নি, যা, তোরা হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নে। ও সব পরে হবে।

অমর আর অনিরুদ্ধর কালই যাওয়ার কথা। কিন্তু হটাৎ কেনই বা শান্ত প্রকৃতির এ রকম অশান্ত হয়ে ওঠা! আর অমর ও অনিরুদ্ধর চৌধুরী এষ্টেট ছেড়ে জরুরী কাজে যাওয়ার তাড়নায় ভাটা পড়া! আর সব কিছুর উপরে রামদয়ালের সৌম্য শান্ত ভাব!
কথাটা বলে এ সব নিয়ে ভাবতে ভাবতে, কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবে নীলিমা চৌধুরী অন্দর মহলের দিকে পা বাড়ালেন।

অমর ওর লোক জন নিয়ে প্রায় সব সময় বাইরে বাইরে থাকে। আর বলতে গেলে অনিরূদ্ধ আর রামদয়ালের খোজই মেলে না প্রায় সারাদিন। নীলিমা চৌধুরীও লোকজন নিয়ে চৌধুরী ভবনের আঙ্গিনার বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে থাকা সব ভাঙা ডালপালা সরিয়ে ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত।
ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগলো চৌধুরী এষ্টেটে। হটাৎ করে ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠা প্রকৃতির রোষের ছোবলের দাগ মুছে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো।
দামোদর শান্ত হয়ে সব জঞ্জাল ধুয়ে মুছে নিজ বুকে করে বয়ে নিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিল আপন সীমায়।
জঞ্জাল, ধুলো কাদা মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন রুপে আবির্ভূত হল চৌধুরী এষ্টেট।

কয়েকদিন পর একদিন সকালে রামদয়াল পোষ্ট অফিস থেকে একটা টেলিগ্রাম এনে নীলিমা চৌধুরীর হাতে দিয়ে বললোঃ
-এ টেলিগ্রামের আর কোন মুল্য নেই এখন, চৌধুরী মা, কারণ লাবনী আপামনি এতদিন নিশ্চয় পৌছে গিয়েছে তার নিজ বাড়ীতে। টেলিগ্রামে লেখা আছে -লাবনী আপামনির বাবা আসবেন শিঘ্রই ওকে নিতে। বিদেশ থেকে ওর স্বামী আসবে তায়।

নীলিমা চৌধুরী টেলিগ্রামটা পড়ে শেষ করতেই রামদয়াল খামে ভরা মুখ আঁটা আরো একটা চিঠি তার হাতে দিল।
মাস খানেক আগের লেখা চিঠি, রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠান।
অবাক হলেন নীলিমা চৌধুরী খামটা দেখে। আমান চৌধুরীর চিঠি, নীলিমার কাছে লেখা।
আমান চৌধুরী অর্থাৎ স্বামীর বড় ভাই স্থায়ী ভাবে লন্ডনে বসবাস করেন। বিয়ের পর বোধহয় দুএকবার দেখা হয়েছে। নীলিমাকে তিনি অপছন্দ করেন তা জানেন নীলিমা চৌধুরী। কারণটাও এতদিনে উপলব্ধি করেন।
ছোট ভাই আমির চৌধুরীর একাকী জীবন তাকে খুব কষ্ট দিত, আর তার জন্য তিনি নীলিমাকেই দায়ী করতেন। নীলিমার এত স্বাধীনচেতা মনোভাব তিনি একদম পছন্দ করতেন না।
নীলিমা চৌধুরী সেটা আগে না বুঝলেও স্বামীর অকাল মৃত্যু তার চোখ খুলে দিয়েছে। তাইতো মনটা সব সময় আফসোসে ভরা থাকে।

চিঠিটা দেখে একটা অজানা আশঙ্কায় মনটা ভারী হলো নীলিমার।
বেশ লম্বা চিঠি।
বেশ সময় নিয়ে আমান চৌধুরীর চিঠিটা আগা গোড়া পড়ে নীলিমা চৌধুরীর মনে অপরাধ বোধটা আরো প্রকট হয়ে উঠল।
নীলিমা চৌধুরী বুঝলেন একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমান চৌধুরী চিঠিটা ওকে লিখেছেন।
জমিদারির এই ক্রান্তিকালে একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষীর মত স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্র, অমরের জীবনের কঠোর বাস্তবতা সাথে করে নিয়ে, তার পাশে দাঁড়িয়ে সব উত্তাপ শুষে নিতে তিনি দেশে আসছেন।
জীবনের সে সব বাস্তবতা উল্লেখ করে বিস্তারিত লিখেছেন চিঠিতে।
চিঠিটা পড়ে শেষ করে প্রশান্তির একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো নীলিমার বক্ষ স্ফীত করে।

-রামদয়াল, ভাইজান এসে পৌছাবেন যে কোন দিন।
চিঠিটা ভাজ করে খামে ভরতে ভরতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রামদয়ালের চোখে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন নীলিমা চৌধুরী।
ঘন কালো মেঘ সরে যেমন সূর্য কিরণ বৃষ্টি স্নাত চারদিক উদ্ভাসিত করে, তেমনি এক প্রশান্তিতে ভরে উঠল নীলিমা চৌধুরীর মুখাবয়ব।
কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন, সে কথা শুনে রামদয়ালের ভিতর তেমন কোন অতিরিক্ত ভাবাবেগের সৃষ্টি হল না।

-তাহলেতো অতিথি শালাটা ঝেড়ে মুছে ঠিক ঠাক করতে হয়।
রামদয়ালের কথায় নীলিমা চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন -অতিথি শালা কেন, বাড়ীর ছেলে বাড়ী ফিরছে, অন্দর মহলে থাকবেন তিনি। খোকার ঘরটা সহ আরো একটা ঘর ঝেড়ে মুছে পরিপাটি কর।
নীলিমা চৌধুরীর কথায় কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো রামদয়াল তার দিকে।
-ভাইজান, আকাশকেও সাথে নিয়ে আসছে। আমার দাদু ভাই আসছে!
শেষের কথাটা কিছুটা স্বগত স্বরে বলতে বলতে বুক ষ্ফিত হয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো নীলিমা চৌধুরীর।
রামদয়াল একটু উচ্ছাস প্রকাশ করতে যেয়েও যেন মাঝ পথে থেমে গেল।
নীলিমা চৌধুরী তাকালেন রামদয়ালের চোখে।
অমর সম্পর্কে রামদয়াল সব জানে তা তিনি বুঝতেন আগে থেকেই। কিন্তু ঠিক কি জানতো সেটা জানতেন না তিনি।
- রামদয়াল, তুই কি চিঠিতে আরো কিছু লেখা আছে কিনা সেটা জানতে চাচ্ছিস?
একটু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন নীলিমা চৌধুরী।
রামদয়াল নীলিমা চৌধুরীর সে নির্মল হাসিতে ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কোন জবাব দিল না।
-হ্যে, ভাইজান আমার বউমাকেও সাথে নিয়ে আসছেন।
অনেক দিন পর কারো যদি এক ঘুমে রাত কাটে তাহলে সকালে যেমন দেহ মন স্বস্তিতে ভরা থাকে, তেমনি একটা স্বস্তির পরশে যেন ভরে উঠল রামদয়ালের দেহ মন।
কাচারি ঘরের উচু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলো ঝলমলে গাছের ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল রামদয়াল।

ডাঃ লাবনী মোহ ভঙ্গ হয়ে তার পুরনো দুনিয়ায় ফেরত গেল।
ডাঃ অনিরুদ্ধ পাকাপাকি ভাবে তার জীবনের আগের পিঠটা বন্দ করে এখানে জীবনের অন্য পিঠটা নতুন করে শুরু করার বাসনা চরিতার্থে এ জীবনটা পাকাপোক্ত ভাবে আরম্ভ করার মনস্ত করল।
নতুন জমিদার অমর চৌধুরী তার এলোমেলো ভাবে শুরু হওয়া জীবনের আগের পিঠটা এ পিঠের সাথে মিলে পূর্ণতা পাবে বলে ওর মা নীলিমা চৌধুরী সুখ স্বপ্নে ডুব দিলেন। তিনি নিজেও তার জীবনের আগের পিঠের ভুল সংশোধন করে নতুন করে ছেলেকে নিয়ে সুখের দিন শুরু করার স্বপ্নে বিভোর হলেন।
এক পিঠে জীবন রামদয়ালের। চৌধুরী এষ্টেট দিয়ে শুরু এখানেই শেষ। এপিঠ ওপিঠ সব মিলেই তার কাছে চৌধুরী এষ্টেট। সে প্রবাহটা একটু যেন দিক হারিয়ে থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়ে, আবার দিক ও গতি ফিরে পাওয়ায় চৌধুরী এস্টেটের মত সেও প্রফুল্ল।