জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' পর্ব -২২।

আপডেট: ২৮ অগাস্ট ২০২২, ১৩:৫৯

অমৃতের সন্ধানে-২২ 

 

পুরোনো জমিদার বাড়ী, শত বছরের তো হবেই। এর সব কিছুই যেন এক একটা ইতিহাস। কত কিছুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কড়িকাঠ আর সিলিং এর খসে পড়া গাথুনি যেন সেই সব ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়।
সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে এটার প্রকৃত মালিক যেন টুপ করে চুপিসারে বিদায় নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে সবার অলক্ষে দেখছে। আহ নিজের সৃষ্টিকে দূর থেকে এভাবে দেখা যে কি তৃপ্তি তা অশরীরি আত্মারায় কেবল বোঝে।
পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় মানিকের কাছে সব স্বপ্নের মত অনুভূত হতে লাগলো। ভাবলো বৃদ্ধ দারোয়ানকে আবার পেলে সব জিজ্ঞেস করবে।
নিজেকে এই স্বপ্নীল ঘটনার একটা অবিচ্ছেদ্দ অংশ বলে মনে হলো ওর কাছে। একটা অজানা তৃপ্তির আস্বাদে ওর দেহ মন ভরে যেতে লাগলো। অজানা পথ চলতে অভ্যস্ত পথিক তার মনের গভীরে লালিত অব্যক্ত স্বপ্নে দেখা গন্তব্যের কাছাকাছি আসলে যেমন পাওয়ার আনন্দকে দীর্ঘায়িত করার জন্য একটু বিশ্রাম নিতে চায় এ যেন তেমনি এক অলসতা।
এই মুহুর্তে নিজের কাছে ওর এত হালকা লাগছে যে, ফেরী ঘাটের ঐ দোকানীর মত মনে হলো নিজেকে। একটু খানি জায়গা হলেই ফেরিটাতে সেও উঠে যেতে পারবে।
দোকানীর কথাগুলো মানিকের মনে পড়তে লাগলো। মায়া কাটাতে হবে।
-কাটানোর মত মায়া আর কিই বা আছে মানিকের!
সব ছেড়ে ছুড়ে যা কিছু উপার্জন ছিল তার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ওর পর দাদার ভিটেয় একটা হাসপাতাল তৈরী করেছে। তখনই বাবার সাথে ওর শেষ যোগাযোগ। এমনিতেই অবশ্য বাবার সাথে ওর যোগাযোগটা চিরকালই আনুষ্ঠানিক, শুধু প্রয়োজনের সম্পর্ক।
ওর সব কিছু ছেড়ে গ্রামে চলে আসার ব্যপারটা বাবা মেনে নিতে পারেননি। বেশ হট্টোগোলও করেছিল অন্য দশজন বাবার মতই। করাটাই স্বাভাবিক। সব বাবাই চায় সন্তান সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক, নাম যশ টাকা পয়সার মালিক হোক। কিন্তু তিনি পৈত্রিক জমিতে হাসপাতাল তৈরীর ব্যপারে আপত্তি করেননি একটুও।
বাবাও গত হয়েছেন বছর খানেক হলো।
নানীকে সব সময়ই মনে পড়ে, কিন্তু সেওতো এখন সবার ধরা ছোয়ার উর্ধ্বে। নানীর ভালবাসাটা প্রতিনিয়তই ওকে টানে। তার ভালবাসাতে অমৃত ছিল। নানীর কাছ থেকে শেষবারের মত বিদায়ের মূহুর্তটা ওকে খুব পীড়া দেয়। বিদায় দেয়ার শেষ মূহুর্তে নানী যে ওকে কি বলতে চেয়েছিল সে প্রসঙ্গটা নতুন করে মানিকের সামনে এসে হাজির হলো। এর আগেও অনেকবার চেষ্টা করেছে সেটা মনে করার কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারিনি।
কিন্তু এই মূহুর্তে নানী যে কি বলেছিলো সেটা মনে করার প্রয়োজনটা খুব তীব্র ভাবে অনুভূত হতে লাগলো মানিকের কাছে। ঐ মূহুর্তে নানীর প্রতিটি কথাবার্তা, অঙ্গসঞ্চালন মনে করার চেষ্টা করলো মানিক।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর নানীর সাথে শেষ বারের মত দেখা হয়েছিলো মানিকের। মানিক ইচ্ছা করেই ওর শরীরের ঐ অবস্থা নিয়ে নানীর সামনে যেয়ে অযথা ওকে কষ্ট দিতে চায়নি।
ততোদিনে প্লাষ্টিকের পা লাগিয়ে জীবন চালানোর মত ব্যবস্থা করে নিয়েছিল মানিক। ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেদেছিলেন রোকেয়া বেগম। মানিক বুঝলো অনেক পরিবর্তন হয়েছে ওর নিজের মধ্যে। সেই ভালবাসা সেই উষ্ণতা সবই আছে কিন্তু আগের মত মন খুলে সব কিছু তাকে বলতে পারছিলো না।
বুক ভর্তি কথা ছিল কিন্তু কিছুই বলা হলো না। ব্যপারটা বোধহয় নানীও বুঝতে পারলেন। নানী সম্ভাবতঃ আরো বুঝতে পেরেছিলেন মানিকের সাথে ওটাই ওর শেষ দেখা। তায় বেশী কথা না হলেও সারাক্ষন মানিককে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন তিনি।
বিদায় দেয়ার সময় খেয়া ঘাটে বসে যে যে প্রসঙ্গ আলোচনা হয়েছিল তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করলো মানিক। ওর মুখটা ওর ঠোট দুটো চোখের সামনে এনে তা পড়ার চেষ্টা করলো মানিক।
এই মূহুর্তে নানীর প্রয়োজনটা দারূন ভাবে উপলব্ধি করতে লাগলো ও। অজান্তেই চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো মানিকের।
হটাৎ করে নানীর ক্ষীন কণ্ঠস্বর ওর কানে বাজলো। মনে হলো সে যেন শিউলি সন্মদ্ধে কিছু একটা বলেছিলো।
-কি বলতে চেয়েছিল নানী শিউলি সম্পর্কে!
কত বছর হয়ে গেল মানিক একবারও শিউলির খবর নেয়নি। ভাবনাটা ওকে কিছুটা হতবিহ্বল করে দিল।
-তা কি করে হয়! শিউলিকে ও কি ভাবে ভুলে থাকলো। মানিক নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় বিচারের জন্য দাড় করালো।
কিন্তু কিছুতেই নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারলো না মানিক।
ভাবতে ভাবতে ও নিজের মনের গভীরে ডুব দিয়ে এক নতুন নিজেকে আবিস্কার করলো। যেখানে শিউলির অস্তিত্ব ওর সারা দেহ মন জুড়ে। সারাক্ষন সারা কর্ম জুড়ে ব্যপৃত শিউলি। শিউলি যেখানেই থাকুক ও চিরকাল মানিকের হয়েই থাকবে।
মানুষের মনের বোধহয় অনেকগুলো তলা থাকে। সবচেয়ে উপর বা তার কাছাকাছি তলা গুলোতে যে সমস্ত চিন্তা চেতনার বাস সে গুলো সব দৈনন্দিন আর ভবিষ্যৎ বৈষয়িক কাজের সাথে জড়িত। ওগুলো হয় বিভিন্ন ভাবে দেহাবয়বে প্রকাশিত হয়, নয়তো মানুষ তা ইচ্ছা করে প্রকাশ করে। এ গুলো ঘটে সব চেতন মনে।
কিন্তু কিছু ভাবনার স্থান একদম মনের গভীরে নিচ তলায়। জায়গাটা একদম নিষিদ্ধ। যা কিছু ঘটে তা চেতন অবচেতন দুভাবেই। যে চিন্তা গুলো মানুষ কারো সাথে ভাগাভাগি করতে পারে না। সেখানে সকলে এক অন্য মানুষ, যার চেহারা কেউ দেখেনি।
এই প্রকোষ্ঠে থাকা ভাবনাপ্লুত নিজ চেহারাটা প্রথ্যেক মানুষ আঁচ করতে পারে। কিন্তু সে তা যক্ষের ধণের মত করে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। প্রতি মানুষেরই মনের এই প্রকোষ্ঠে লালিত এমন অনেক ভাবনা থাকে তা সে কখনই কাউকে ভাগ দিতে পারে না।
ঐ চেহারাটা মানুষের নিজের কাছেও অপরিচিত। কখনো কোন কারণে ভাবনাটা যদি নিজের কাছে প্রতিভাত হয়ে ওঠে তাহলে সে নিজেও অবাক হয়।
এই জোৎস্নাস্নাত রাতে শিউলি সম্পর্কে এমনি একটা ভাবনা আবিস্কারের আকস্মিকতায় হতবাক মানিক।
শিউলিতো ওর সাথেই ছিল সবসময় প্রতি মূহুর্তে। পুরো যুদ্ধের সময়, পরবর্তিতে ওর জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময়।
যুদ্ধের সময় বিপদসংকুল মুহুর্তগুলোতে শিউলির ভাবনায় ওকে অনুপ্রেরণা যোগাতো। প্রতি দিনের ঘটনা সব ভাবনা ও ডায়রীতে লিখে রাখতো। কি ভেবে লিখতো সেটা তখন ভাবিনি। কিন্তু এ মুহুর্তে ও বুঝতে পারছে ওর স্মৃতিগুলো শিউলির জন্য লিখে রাখতো। ও ভাবত স্বাধীন দেশে ও সর্বপ্রথম ওর মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা মানুষটিকে দেখাবে আর সব ঘটনা সব ভাবনা তাকে বলবে।
যুদ্ধের সময় একটা অপারেশানে ওর পায়ে গুলি লাগলো, সে কি ভীষন যন্ত্রনা! তখন উজ্জল আলোকিত দিন। দিনের আলোতে ওরা নড়তে পারলো না একটুও, শুধু নীরবে রক্তক্ষরণ হতে দেয়া ছাড়া, কিছুই করার ছিল না।
তারপর রাতের আধার যখন ওর শীতল চাদর বিছিয়ে দিল তখন ওর সহ যোদ্ধারা ওকে ষ্টেচারে করে হাসপাতালে আনতে অনেক সময় লেগেছিল। রক্ত পড়ে পড়ে ও ভীষন দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মানিক ভেবেছিলো ও বোধহয় মরে যাবে। বেচে থাকার ইচ্ছেটাও প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু কেবল একটা মানুষেরর চিন্তায় ও বাচার তাগিদ অনুভব করেছিল সেদিন।
যুদ্ধ ওর সমস্ত চিন্তা চেতনায় এক আমুল পরিবর্তন এনে দিল। আর চাক্ষুস পরিবর্তন আনলো ওর শারিরীক সামর্থ্যের।
যুদ্ধ থেকে ফিরে কেন জানি নিজের এই অবস্থা নিয়ে শিউলির পরিপূর্ণতায় ভরা জীবনটাকে অযথা ভারী করতে মন চায়লো না। শিউলিকে ও ভালবাসে ওর প্রাণের থেকে বেশী।
পরবর্তিতে ওর ডাক্তার হওয়া, হাসপাতাল তৈরী করা সবইতো তারই দান, তারই চিন্তায় অনুপ্রেরণায়।
শিউলির কাছ থেকে ওকে দেখেই কাজে ডুবে থাকার, প্রকৃতির অংশ হয়ে অমৃতের আস্বাদের সন্ধান এসব মানিক শিখেছে।
-কোথা দিয়ে যে কি হলো!
বুক কাপিয়ে একটা দীঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো মানিকের।
রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ জাতিকে একটা মানচিত্র দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি কত মানুষের জীবনের গতি প্রকৃতি পাল্টে দিয়ে তাদের সব কিছুকে উল্টে পাল্টে দিয়েছে তার খোঁজ কেই বা রাখে।


Read More