জীনন থেকে নেয়া ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' পর্ব -১৪

আপডেট: ০৩ Jul ২০২২, ১৫:২৬

অমৃতের সন্ধানে-১৪ 

 

রাত অনেক হলো মানিক এখনো ফিরছে না। ওকে অনেক্ষন না দেখে রোকেয়া বেগম খুজতে খুজতে এদিকে এসেছেন। মানিক বলে ডেকে ডাকটা নিজের মুখের মধ্যে থাক্তেই ঘাটের দিকে চোখ পড়লো রোকেয়া বেগমের। তিনি থমকে দাড়ালেন।
মানিক শিউলির গায়ে হেলান দিয়ে বসে আর শিউলি স্নেহভরে ওর চুলের ভিতর অঙ্গুলি সঞ্চালন করছে। মমতাই ভরা আদর দেয়া নেয়ার এক স্বর্গীয় দৃশ্য মনে হল রোকেয়া বেগমের কাছে।
রোকেয়া বেগমের বুকটা হালকা করে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
আদরের পাগল ওর মানিক। শুধু একটু আদরই ওর দরকার আর কিচ্ছু চায় না ওর। ভাবলেন তিনি।
এই মানিকের দিকে তাকিয়েই বড় আদরের মেয়েকে হারানোর জন্য বুক ভরে একটু কাঁদতেও পারেনি রোকেয়া বেগম। নিজে ভেঙ্গে পড়লে মানিককে কে দেখবে তা ভেবে।
মেয়েটা ওর অভিমান করেই বিদায় নিল। শেষ নিঃশ্বাসটা নেয়ার আগে পাশে খেলায় মসগুল মানিকের দিকে তাকিয়ে ওর দুচোখ বয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। ক্ষীন কণ্ঠে গলার মধ্যে ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ করে বলেছিলো -মা তোমার মানিক থাকলো।
এই মুহূর্তে রোকেয়া বেগম ভাবলেন - মানিকের কষ্ট বোঝার মত, ওকে একটু আদর দেয়ার মত যদি কোন দরদী কেউ থাকতো তবে তিনি শান্তিতে চোখ বুজতে পারতেন।
মানিকের মত হতভাগী শিউলিও। কথাটা ভেবে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস টানলেন রোকেয় বেগম।
ওদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন- মানিক তুই এখানে।
ওরা দুজনেই কথাটা শুনলো, রোকেয়া বেগমের উপস্থিতি টের পেল। কিন্তু কেউই একটুও নড়েচড়ে বসার তাগিদ অনুভব করলো না।
রোকেয়া বেগম মানিকের গা ঘেসে বসলেন। নানীর স্পর্শ পেয়ে মানিক ওর মাথাটা শিউলির কাঁধ থেকে সরিয়ে নানীর কাঁধে হেলান দিল। শিউলি তাকিয়ে দেখলো একটু ,তারপর উঠে রাঙাদাদির অন্য পাশে বসে ওর মাথাটাও একই রকম ভাবে রাঙাদাদির অন্য কাঁধের উপর রাখলো। রোকেয়া বেগম দুটি হাত স্নেহভরে দুজনার মথায় বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
নিঃস্বার্থ প্রেম ভালবাসা স্বর্গীয়, আর এগুলো যত দান করা যায় কমে না বরং বাড়তেই থাকে। এর স্বার্থকতা দানের মধ্যেই। এ মুহুর্তে ভালবাসার কাংগাল দুটি প্রাণ এই স্বর্গীয় অমৃতের আস্বাদ গ্রহনে নিমগ্ন।
দুজনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রোকয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন- বেলাল কি বাইরে কোথাও গিয়েছে।
এ সময়ে বেলালের প্রসঙ্গটা শিউলির কাছে বড্ড বেমানান আর অপ্রাসঙ্গিক লাগলো। শিউলির মনে হলো ওর স্বাধীন আর একান্ত চিন্তা চেতনা আর নিজের পছন্দনীয় জগতের মধ্যে বারবার বেলাল প্রসঙ্গ অযাচিত ভাবে অনুপ্রবেশ করছে।
কথাটা চিন্তা করতেই ও একটু যেন হোচট খেলো। বেলাল প্রসঙ্গটা বলা যায় সামাজিক স্বীকৃতিতেই ওর জীবনের সাথে বাধা হয়ে গেছে । বেলালের এখানে বর্তমানে অবস্থান সেই স্বীকৃতিরই ফল। অতএব বেলাল প্রসঙ্গ তার জীবনে বেসুরো বা অযাচিত কেন হবে!
সব কিছুই শিউলির কাছে এই মূহুর্তে এলোমেলো লাগলো। ও কি চায় সেটায় ওর কাছে অস্বচ্ছ লাগলো। বেলালকে যদি ওর অপছন্দই তবে এত দিন যাবত কাউকে কিছু বলেনি কেন? কেউ তো কোন জোর ওর উপর করেনি। বা ওর অগোচরে গোপনে গোপনেও তো কোন কিছুই হচ্ছে না।
কাকে ও দোষারোপ করবে, নিজেকে ছাড়া!
শিউলি উঠে দাড়ালো।
-না, ও কোথাও যায়নি, বোধহয় ঘরে বসে পড়াশোনা করছে।
কথাটা বলে অনেকটা নিঃশব্দে উঠে বাড়ীর দিকে চলে গেল শিউলি।
রোকেয়া বেগম একটু অবাক হলেন। অবাক হলো মানিকও।
বেলালের সাথে কোন ব্যপারে ঝগড়া বা মনোমানিল্য হয়েছে? ভাবলেন রোকেয়া বেগম। কিন্তু বেলালের সাথে শিউলির তো তেমন কথাবার্তাই হয়না বলে জানেন তিনি। তাহলে। বেশ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লেন রোকেয়া বেগম। বেলালের প্রতি শিউলির মনোভাব কয়েকদিন ধরেই ঠিক স্বাভাবিক নয় বলে মনে হলো ওর।
হটাৎ করে ওভাবে শিউলির চলে যাওয়াটা চিন্তাযুক্ত করলো মানিককেও। শিউলির সাথে ওভাবে কথা বলা কি তার উচিত হয়নি? নিজেকে প্রশ্ন করলো মানিক। কিন্তু কই তার জন্য ওর মনে কোন আফসোচ বা অপরাধ বোধ হচ্ছে না। ভাবলো মানিক।

বেশ কয়েকদিন হলো শিউলির সাথে দেখা হয়নি মানিকের। মনটা ভালো নেই ওর। একটা বিশেষ ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। আলাপ করার মত কাউকে না পেয়ে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু এ কয় দিনে ওকে নিয়ে ভাবেনি তা নয়, তবে শিউলি সম্পর্কে ওর হিসাবটা কিছুতেই মিললো না। তার উপর ওর শরীরটাতে একটু জর জর বোধ হওয়াই নানীও ওকে বাইরে বেরূতে দেয়নি।
সেদিন শরীরটা একটু ভালবোধ হওয়াই মানিক সকালে উঠে বাড়ীর সামনে বেরূলো একটু হাটাহাটি করার জন্য। কাচারিঘরে কিছু মানুষের সমাগম দেখে ও একটু অবাক হলো।
দেখার জন্য সে দিকে এগিয়ে যেতেই বুঝলো এরা সবাই রোগী। ভালো লাগলো মনটাতে ওর। ভাবলো বেলাল আদর্শবান মানুষ, বিলেত ফেরত ডাক্তার। ওর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল মানিকের।
বাড়ী ফিরে নানীর কাছে প্রসঙ্গটা তুললো মানিক।
-নারে বেলাল না, শিউলি কয়েকদিন হলো ওর বাবাকে বলে গ্রামের লোকজনের চিকিৎসা শুরূ করেছে। বড় মন মেয়েটার।
শিউলি বিনা পয়সায় গ্রামের রোগীদের চিকিৎসা করতে চায়। ভারী খুশী হলো ওর বাবা। সময় ক্ষেপন না করে কাচারিঘরের একটা রূমে সব ব্যবস্থা করে দিলেন।
সময় বেধে দিয়ে রূগীদের দেখতে শুরূ করলো শিউলি। সবাই খুশী হলো, উৎসাহ দেয়ে বিভিন্ন ইতিবাচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করল কেবল বেলাল ছাড়া।
-সময় কাটানোর জন্য উদ্যোগটা চমৎকার, কিন্তু দেখ কদিন ধৌর্য্য রাখতে পারো। বেলালের মন্তব্যটা গায়েই লাগালো না শিউলি।
ধৌর্য্যরে কোন ঘাটতি হবে না শিউলির। কারণ সময় কাটানোর জন্য নয় বরং অসহায় দরীদ্র মানুষকে সেবা করা আর ওদের পাশে দাড়ানোর মানসিকতা নিয়েই কাজটা শুরূ করেছে শিউলি।
এই গভীর গ্রামে একেতো ডাক্তার দুস্প্রাপ্য তারপর বিনা পয়সায় চিকিৎসা‐ রূগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগলো।
সকাল হতে না হতেই কাচারিঘরের সামনে রোগীরা ভীড় করতে শুরূ করে। প্রথমে ওদের নিজ গ্রামের মানুষ, তার পর ধীরে ধীরে দুরদুরান্ত থেকে কত মানুষ আসা শুরু করলো।

সব রূগী দেখে শেষ করতে কোন কোন দিন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। প্রতি রুগীকেই অনেক্ষন ধরে সময় দিতে হয়। কারণ শুধু রোগের চিকিৎসাই না, গায়ের মেয়ে হিসাবে সবাই রোগ শোকের পাশাপাশি অন্যান্য সুখ দুঃখের কথাও আলোচনা করে।
ইতিমধ্যে শিউলির বাবা ওর পরামর্শ অনুযায়ী ওকে অনেক অসুদপত্রও কিনে দিয়েছে। যেগুলি ও অভাবগ্রস্থ রোগীদের মধ্যে বিলি করে। এ কাজ ওর জীবনের রূটিনটাই যেন পরিবর্তন করে দিয়েছে। শিউলি যেন রাতারাতি এই অভাবগ্রস্থ অশিক্ষিত মানুষদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠেছে।
শিউলি এখন স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। নিজেকে নিয়ে নয় এসব মানুষকে নিয়ে। ও এখন অজানা অসম্ভব গন্তব্যে যাত্রার রোমাঞ্চের সন্ধান পেয়েছে।
প্রায় সারাদিনই ব্যস্ত থাকার পর ও যখন ওর ক্লান্তিতে ভরা দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় তখনো ঐ সব রোগাক্লিষ্ট দারীদ্রের কষাঘাতে ক্ষত বিক্ষত মুখ গুলোই ওর মানসপটে ভাসতে থাকে। কত অনিশ্চয়তা নিয়ে, কত মানষিক আর শারিরীক যন্ত্রনা নিয়ে ওদের জীবন এগিয়ে যায়।
ও এতদিন নিজের মত বেদনাক্লিষ্ট মুখের সন্ধান করতো। এখন ওর মানষপটে আঁকা অনেক বঞ্চিত মুখের ভীড়ে নিজের মুখের চেহরাটায় নিজের কাছে ঝাপসা লাগে। শিউলি জীবনের এক অন্য অর্থ খুজে পেয়েছে। বড়লোক বাবার আশ্রয়ে লালিত হয়ে রঙিন চশমার ফাক দিয়ে দেখা পৃথিবীটা ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। শিউলি এতকাল কেবল পাওয়ার মধ্যেই তৃপ্তির সন্ধান করতো। দেয়ার তৃপ্তির স্বাদটা ওর কাছে অজানা ছিল। এখন ও নিজের মূল্য অনুধাবন করতে শিখেছে। অন্যকে দেয়ার মত যে সম্পদ ওর আছে তা যত দেয়া যায় ততোই বৃদ্ধি পায় এ উপলব্ধি ওর মধ্যে জন্মেছে।
এ ধরনের মানুষদের জন্য একটা হাসপাতাল, একটা অভয়াশ্রম গড়ার তাড়নাটা ওর কাছে প্রকট হয়ে দেখা দিতে লাগলো।
বেলালের মতানুযায়ী যুদ্ধ যখন শুরূ হয়েছে দেশ তখন স্বাধীন হবেই। তবে অনেক সময় লাগবে, অনেক মানুষ মারা যাবে ইত্যাদি। তার হিসাব মত চার পাচ মাস যুদ্ধ চলার পর যুদ্ধের গতি একটু স্তিমিত হয়ে আসবে। তখন উভয়পক্ষ নতুন উপায় নির্ধারনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। বেলালের প্লান অনুযায়ী ঐ সময়েই ও শিউলিকে নিয়ে লন্ডন রওয়ানা হবে।
কিন্তু বেলালের হিসাবকে মিথ্যা প্রমান করে যুদ্ধের গতি দিন দিন বাড়তেই থাকলো। যুব সম্প্রদায়ের যুদ্ধে যোগদানের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো।
শিউলির ব্যস্ততা বেলালের কাছে অনর্থক এক খেয়াল মনে হলেও মানিকের কাছে তা এক অনন্যসাধারণ মহনুভবতা মনে হতে লাগলো।
অনেকদিন কাজে নিমগ্ন শিউলিকে কাচারিঘরের জানালার ফাক দিয়ে দেখেছে মানিক। ওকে অপরূপা স্বর্গীয় দূত মনে হয়েছে। মনে হয়েছে ওর অবস্থান এখন অনেক উপরে। মাঝে মাঝে মনের অজান্তে বেলালের জাইগায় নিজেকে চিন্তা করে ওকে নীবিড় ভাবে সাহায্য সহযোগিতার কথা কল্পনা করেছে। কিন্তু নিজের মানদন্ডে নিজেকে বড় অনুপযুক্ত আর বেমানান মনে হয়েছে মানিকের কাছে।
দুএকবার ভেবেছে ওর কাছে যেয়ে ওকে একটু অনুপ্রেরণা যোগায়। কিন্তু ওর কাজের একাগ্রতার কাছে ওর এ প্রয়াস একান্ত নিরর্থক মনে হয়েছে।
এই মুহুর্তে এখানকার জীবনটা মানিকের কাছে বেশী করে একঘেয়ে আর অর্থহীন মনে হতে লাগলো। দেশের জন্য যখন সবাই কিছু না কিছু করতে এমনকি জীবন দিতে ব্যস্ত তখন এখানে এভাবে লুকিয়ে থাকা ওর কাছে অনর্থক এবং তদুপরি অপরাধ বলে মনে হতে লাগলো।
এখানে এভাবে লুকিয়ে থাকাটা বেলালের কাছেও অনর্থক সময়ের অপচয় বলে মনে হতে লাগলো। কত কাজ পড়ে আছে ওর।
বেলাল মামার কাছে শিউলির সাথে বিয়েটা যথাশিঘ্র সম্পন্ন করে তারপর সুযোগ বুঝে শিউলিকে নিয়ে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তাব করলো। দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, কখন কি হয় কিছুই বলা যায় না।
তাছাড়া ওর এখানে থেকে লাভটাই বা কি। লন্ডনে যেয়ে ঠান্ডা মাথায় বরং দেশের জন্য অনেক কিছু করা যাবে। এছাড়াও বেলাল শিউলির নিরাপত্তার ব্যপারটিও বিশেষ গুরূত্বের সাথে ব্যক্ত করলো। এ পরিস্থিতিতে শিউলির এখানে থাকাটা সে সমর্থন করে না বলেও সাফ জানিয়ে দিল।
লন্ডন থেকে আসার পূর্বে একটু চিন্তা ভাবনা বুদ্ধি বিবেচনা করে না আসার জন্য ও নিজেকে সবার সামনেই সমালোচনা করলো। লন্ডনে কত কাজ পড়ে আছে চিন্তা করে ওর বোকামির জন্য সে খুব আফসোচ প্রকাশ করে বললো- এর থেকে বরং শিউলিকেই লন্ডনে নিয়ে বিয়েটা ওখানে হলে এই ঝামেলার হাত থেকে রেহায় পাওয়া যেত।
বেলাল একটা সিদ্ধান্তে পৌছানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো।
ওর মানষিকতা পরিস্কার করার জন্য বললো -এখন ভাবছি অন্যের কথা না শুনে লন্ডন থেকে আসবার পূর্বে নিজের মতের উপরই নির্ভর করাই ঠিক ছিল।
বেলালের মন্তব্যে শিউলি ও ওর বাবা দুজনেই চমকেই উঠলো। অন্যের বলতে বেলালতো শিউলি আর ওর বাবাকেই বোঝাতে চাচ্ছে!
একটু ইতস্ততঃ করে শিউলির বাবা বেলালকে উদ্দেশ্য করে বললেন -আসলে কি জান বাবা আমাদেরতো সমাজ নিয়ে চলতে হয়, আর যুদ্ধটা যে এত তাড়াতাড়ি শুরূ হবে তায় বা কে জানতো বলো।
একটু মৃদু হেসে বেলাল জবাব দিল - মামা সামাজিকতার কথা বলছেন, অর্থহীন সামাজিকতাকে বাদ দেয়ার সময় এসেছে। দুনিয়া যেখানে তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে সেখানে আমরা সে যুগের সামাজিকতা নিয়ে থাকলে কি চলবে।
বাবা মেয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। তারপর শিউলির ঈশারায় ওর বাবা ওকে নিয়ে উপরের ঘরে গেলেন।