জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'ঝর্ণা পাড়ের নয়নসোনা'।

আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২২

ঝর্ণা পাড়ের নয়ন সোনা

 

পাহাড়ি এলাকা, গভীর খাদ ধরে সারাক্ষন কুল কুল করে বয়ে চলা সুরু একটা ঝরনার পাড়েই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের তৈরি রবিনের অফিস কাম বাসস্থান। সাপ পোকড়ের কথা চিন্তা করে পাচ ছয় ফুট উঁচু মাচার উপর তৈরি তিন কামরার কাঠের ঘর।
ঝরনাটা ঘরের পিছন দিকে। পিছনে বেশ কিছুটা জায়গা সমান করে বেঞ্চ পেতে বসার ব্যবস্থা করা। ঝরনার ধার ঘেঁসে মাজা অব্দি কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা, বেখেয়ালে কেউ যাতে প্রায় পঞ্চাশ ফুট নিচ দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার ভিতর পড়ে না যায় সে চিন্তা করেই সেটা তৈরি।
বন বিভাগের চাকরী, তাই বনে বাদাড়ে জীবন কাটানোর মানসিকতা গত পাচ বছরের গড়ে তুলেছে রবিন।
কিন্তু এবার তার এই তৃতীয় পোস্টিংটা হল একটা হার্ড স্টেশানে।
রেঞ্জের দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রতিদিনই দুজন রক্ষীকে সাথে নিয়ে সকালে বেরিয়ে ফিরতে সন্ধ্যা হয় রবিনের। সন্ধ্যার পর ঘন্টা দুয়ের মত একটা হোন্ডা জেনারেটর চলে, তারপর সব অন্ধকারে ডুবে চারদিক নিশ্চুপ হয়ে যায়। রবিনের অফিস কাম বাসা ছাড়াও একই কমপ্লেক্সে স্টাফদের জন্য একটা অফিস, তাদের বাসস্থান আর একটা রান্নার ঘর।
নির্জনতা রবিনের খুব পছন্দ, তাই সন্ধ্যার সাথে সাথে গর্জে ওঠা ওই ছোট্ট জেনারেটরের শব্দটা দারুন বেখাপ্পা লাগে ওর কাছে। মনে হয় ওই যন্ত্রটা কাজের থেকে অকাজ করে বেশী।
সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থেকে ক্লান্ত দেহে ফিরে ব্যারেলে ভর্তি করা ঝরনার ঠান্ডা পানিতে স্নান করেই রাতের খাবার খেয়ে নেয় রবিন। তারপর লাইট অফ হয়ে এলাকাটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হলে সে বাসার পিছনে ঝরনার গাঁ ঘেসে দাঁড়ানো খোলা জায়গাটাতে এসে বেঞ্চে বসে।
ঘন অন্ধকার আর অভেদ্য নির্জনতার মধ্যে এ সময়টাতেই ঝরনার কুল কুল বয়ে যাওয়া শব্দটা পরিষ্কার ভাবে কানে এসে লাগে। শব্দটা ওকে সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে দেহ মনে এক স্বর্গীয় প্রশান্তি এনে দেয়। বয়ে যাওয়া ঝর্ণার শব্দটা সন্ধ্যার পর ওকে খুব টানে। ঘুমে চোখ দুটো বন্দ হয়ে আসার আগ পর্যন্ত সময়টা রবিন ওখানেই বসে কাটায়।

এক ছুটির দিনে সকালে ঝরনায় নেমে উজানে অনেক খানি হেটেছিল রবিন সেটার উৎপত্তি স্থান দেখার জন্য। কিন্তু পুরো বেলা ঝরনা ধরে উজানে হেটেও কোন কুল কিনারা করতে না পেরে ফিরে এসেছিল।
অজানাকে জানা রবিনের একটা সখ বলা চলে এবং কিছু খুঁজে বের করার মধ্যে ও একটা এ্যডভেঞ্চারের গন্ধ পায়, যা ওর খুব পছন্দের একটা বিষয়। ঝরনাটা ধরে সেদিন উজানে হাটতে ওর যতটা না ক্লান্তি এসেছিল তার থেকে বেশী করে মনটা ভরেছিল এই ভেবে যে এটার কোন শেষ নেই।
অসীমতা বিষয়টার প্রতি রবিনের আলাদা একটা টান আছে। ঝরনা ধরে উজানে হাটতে হাটতে কিছুক্ষণ পর পর ঝরনাটা অনেকগুলো শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে সেটার মুল ধারাটা যে কোনটা তা নিয়ে ও সন্ধিহান হয়ে উঠেছিল সেদিন। মনে হয়েছিল সে রহস্য ভেদ করা বোধহয় অসম্ভব।
ছুটির দিনেও বাইরে বেরলে সাথে গার্ড নিয়ে নেয় রবিন। কিন্তু সেদিন কি একটা মনে হওয়াতে সকালে নাস্তা সেরে ঘরের পিছন দিয়ে বয়ে চলা ঝর্না ধরে চুপিসারে একাকী বেরিয়ে পড়ল রবিন।
ব্যাপারটি নিজের কাছেও একটু হাস্যকর লাগলো। মনে হল সে যেন চুপিসারে সবার অলক্ষে কোন অভিসারে যাচ্ছে। অন্যান্যদের কাছেও ব্যাপারটি অনেকটা সেরকম কিছু অনুভূত হওয়ারই মত। কারণ ও রকম অখ্যাত একটা ঝর্ণার মধ্যে খুজে দেখার মত তেমন কোন চাক্ষুষ বিশেষত্ব ছিল না।
কিন্তু পৃথিবীটা বোধহয় এ রকমি, তাইতো মনিষীরা বলে গেছেন ‘সৌন্দর্য বস্তুতে নয় দর্শনকারীর চোখে থাকে’।
প্রথম দিন ঝর্ণা ধরে যে জায়গা পর্যন্ত এসেছিল সেটুকু নিমিষেই যেন ফুরিয়ে গেল। তারপর শুরু হল অজানাকে উন্মোচন করার অভিযান।
একাকী অভিসার বা অভিযানের এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। নিজের সাথে নিবিড় ভাবে কথা বলা যায়।
রবিন যেন ঝর্ণার প্রেমে পড়ল। ঝরনা ধরে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে ইচ্ছে মত বুক অব্দি ডুবে থাকা পাথরে উপর বসলো, দু হাতের তালুতে ভরে ছুটে চলা ঝর্ণার পানি পান করল। ঝর্ণার গা ঘেসে দাঁড়ানো বুনো ফল তৃপ্তি সহকারে খেল। বুনো পাখীর ডাক আর ঝর্ণার কুল কুল শব্দের মধ্যে হারিয়ে ফেরার চিন্তা মাথা থেকে যেন উবে গেল রবিনের।
হটাৎ করে পা পিছলে পড়ে একটা পাথর খন্ডে মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারাল রবিন।

জ্ঞান যখন ফিরল রবিন তখন নিজেকে একটা আদিবাসীর ঘরে শায়িত অবস্থাই আবিষ্কার করল। আলো আধারিতে ভরা একটা ঘর, ভিতরে কেরোসিনের একটা কুপি জ্বলছে। একটু নড়তে গিয়ে বুঝল ওর মাথাটা একটা কাপড়ে জড়ানো বেশ ব্যথা।
ওকে নড়তে দেখে তাড়াতাড়ি ওর কাছে এসে গায়ে হাত রেখে মাঝ বয়সী এক মহিলা আদিবাসীদের ঢঙে বলল –ব্যটার জ্ঞান ফিরেছে।
আর পাশেই উপবিষ্ট একজন মাঝ বয়সী আদিবাসী পুরুষ উঠে ওর পাশে এসে বসলো।
-এখন কেমন লাগছে বাবা?
-মাথায় খুব ব্যথা।
উত্তর দিয়ে একটু থেমে রবিন জিজ্ঞেস করল -আমি এখানে আসলাম কি ভাবে?
আদিবাসী লোকটি রবিনকে সাহায্য করে উঠিয়ে ঘরের বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে বসাল।
রবিন সব মনে করার চেষ্টা করলো।
ও ঝর্ণার ভিতর পা পিছলে পড়ে যাওয়ার কথা মনে করতে পারল কিন্তু তার পরের কিছু মনে করতে পারল না।
-আমি ওষুধ লাগিয়ে বেধে দিয়েছি। কয়েক দিনেই ভাল হয়ে যাবে। পা পিছলে পড়ে তোমার মাথায় চোট লেগে রক্ত বেরচ্ছিল আর তুমি জ্ঞান হারিয়ে ওখানে পড়ে ছিলে। নয়নসোনা ঝর্ণায় মাছ ধরার সময় তোমাকে দেখে। তারপর ও তার সাথীদের সাহায্য নিয়ে তোমাকে কাঁধে করে বাড়ী নিয়ে আসে।
আদিবাসী লোকটা অর্থাৎ ওর আশ্রয়দাতাকে ভারী ভাল লাগলো রবিনের।
-তোমার রেঞ্জ অফিস আমি চিনি, তুমি একটু ভাল হয়ে উঠলে আমি তোমাকে দিয়ে আসব। ও নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা বাবা।
রবিন চারদিকে তাকিয়ে ওদের ঘর আর মানুষ গুলোকে দেখতে লাগলো। ঘরের মধ্যে আদিবাসী লোকটা আর তার স্ত্রী।
-তুমি কি একা এসেছিলে বাবা? তোমার সাথে আর কেউ কি ছিল?
-না, আমি একাই এসেছিলাম।
-তা, কোন কাজ ছিল এদিকে?
ঝর্ণা দেখতে বেরিয়েছিল কথাটা এদের কাছে কেমন শোনাবে সে কথা ভেবে রবিন প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলো।
-আপনারা সাহায্য না করলে আমার যে কি হত? সে কথা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে।
-নয়নসোনা এ সময় খেলাধুলা করে কিন্তু কি ভেবে ও যে মাছ ধরতে ঝর্ণায় গিয়েছিল জানিনে। ও না গেলে বিপদ হতে পারতো সেটা ঠিক।
তৃতীয় কারো উপস্থিতি না দেখে রবিন ঠিক বুঝল না কাকে সে নয়নসোনা বলছে, যে তাকে ঝর্ণা থেকে অজ্ঞান অবস্থায় তুলে বাড়ীতে নিয়ে এসেছে?
ছুটির সারা দিন কেউ ওর খোঁজ না করলেও সন্ধ্যার পর খাবারের জন্য নিশ্চয় সবাই এতক্ষণে ওকে খোজাখুজি করছে, কথাটা ভেবে রবিন নিজেকে বোঝাল –কাল ভাল হয়ে ফিরে গেলে তখন সবাইকে কিছু একটা না হয় বলবে।
রাতে কিছু একটু মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল রবিন।
সকাল হতেই ঘুম ভাঙ্গল ওর। এতক্ষণে শরীরটা বেশ কিছুটা ঝরঝরে লাগল। ঘরের ভিতর কাউকে দেখল না। ভাবল নিশ্চয় কাজে বেরিয়েছে।
রবিন উঠে বসলো। মাথার ব্যথাটা কমেছে। কিন্তু দাড়াতে যেয়ে বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা পেয়ে আবার ধপ করে বসে পড়ল। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারল না।
বেড়ার ঘর তার ফাঁক দিয়ে বাইরের ঝলমলে আলো চোখে পড়ছে।
খোলা দরজা দিয়ে পনেরো ষোল বছরের একটি মেয়ে প্রবেশ করল। ছিপছপে গড়ন টকটকে ফর্সা গায়ের রং। গায়ে হালকা মেরুন রঙ্গের একটা ব্লাউজের মত জামা আর পরনে কাল রঙ্গের লাল বর্ডার দেয়া পিনন।
রবিনকে উঠে বসা দেখে একটু থমকে দাঁড়াল মেয়েটি। তারপর দৌড় বেরিয়ে গিয়ে ওর মাকে ডেকে নিয়ে আসলো।
ঘরে ঢুকে হাসি মুখে ওর মা রবিনকে তার শরীরের কথা জিজ্ঞেস করল।
-এখন ভাল, কিন্তু কিছুতেই বা পা পাততে পারছিনে, খুব ব্যথা গোড়ালিতে।
ওদের কথার ফাকে মেয়েটি দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেল।
-নয়নসোনা কাল রাতেই কবিরাজকে খবর দিতে গিয়েছিল। ভোরে কবিরাজ এসেছে। খুব ভাল কবিরাজ, তোমার গোড়ালিতে মচকা ব্যথা তিনি ভাল করে দেবেন।
সে রবিনের হাতে একটা লাঠি দিয়ে বলল- কবিরাজ আসার আগেই কষ্ট করে বাইরে এসে হাত মুখ ধুয়ে একটু কিছু মুখে দিয়ে নাও।

জায়গাটা একটা পাহাড়ের উপর কিছুটা সমতল সেখানে বাশের তৈরি একটা বেঞ্ছের উপর বসে রবিন হাতে মুখে পানি দিতে দিতে নয়নসোনার মা দুটো গরম আটার রুটি সহ ডিম ভেজে নিয়ে আসল।
রুটির সাথে ডিম ভাজি রবিনের খুব প্রিয় নাস্তা।
খুব ভাল লাগল ওর। এই প্রায় সম্বলহীন বিজাতীয় পরিবার ওকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচিয়ে ওদের বাড়ীতে এনে চিকিৎসা করছে আবার এত সকালে ওর পছন্দের নাস্তা দিচ্ছে!
-বাবা, নয়নসোনাই বলেছে তোমাকে এই নাস্তা দিতে। সকালে উঠে ওই এ নাস্তা বানিয়েছে। ওটা আমার একটা পাগল মেয়ে। খুব খামখেয়ালি আর চঞ্চল।
নাস্তা শেষ করতে করতেই নয়নসোনা কবিরাজকে নিয়ে হাজির হল।
বৃদ্ধ বয়সী কবিরাজ। ঝাপসা হয়ে যাওয়া চিকন ফ্রেমের উচু পাওয়ারের চশমা চোখে। বয়সের ভারে একটু কুঁজো কিন্ত শরীরটা একদম মেদহীন।
তিনি রবিনের পায়ের গোড়ালিটা ভালভাবে পরীক্ষা করার জন্য জায়গাটাতে চাপ দিতেই রবিন যন্ত্রণায় আ আ করে শব্দ করে উঠল।
তা শুনে নয়ন সোনা খিল খিল করে হেসে উঠল।
নয়ন সোনার মুখের দিকে তাকাল রবিন। এই প্রথম ভাল করে দেখল নয়ন সোনাকে, যে মেয়েটি তার জন্য এমনিতেই এতকিছু করে চলেছে। গোড়ালির ব্যথার বিষয়টা আজ সকালেই কেবল রবিনের অনুভূত হয়েছে। কিন্তু নয়ন সোনা ব্যপারটা আগের থেকেই আঁচ করেছিল, সে জন্যই গত কাল রাতেই সে কবিরাজকে খবর দিতে গিয়েছিল।
নয়ন সোনায় দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইল রবিন। মেয়েটি ওর পায়ের ব্যথার কোন পাত্তা না দেয়াতে রবিন নিজের মনে অজানা একটা জোর খুজে পেল, তাতে ব্যথার অনুভবটাও কিছুটা যেন কমে গেল।
মায়ের মৃদু ধমক খেয়ে নয়নসোনা দুই হাত দিয়ে নিজের মুখটা টিপে ধরে হাসি থামাল।
নয়ন সোনার নির্মল হাসিটা এ মুহূর্তে রবিনের কাছে যেন অতিপ্রাকৃত লাগল।
কবিরাজ মচকানো জায়গাটা তেল দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মালিস করল, তারপর গাছের কিছু শেকড় বেটে ওখানে লাগিয়ে কাপড় পেচিয়ে দিল।
-দুদিন লাগবে সারতে। এ দু দিনে কোন রকম নড়া চড়া করা যাবে না। ওকে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দাও।

কবিরাজ বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করে এ বাড়ীর মানুষদের সাথে ওদের নিজেদের ভাষায় বিভিন্ন কথা বলে হাসাহাসি করে বিদায় নিল।
–চিন্তা করো না বাবা, দেখতে দেখতে সময় কেটে তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। আমি নিজে গিয়ে তোমাকে রেঞ্জ অফিসের বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে আসবো।
নয়নসোনার বাবা রবিনকে আশ্বস্ত করল।
রবিনও নিরুপায় হয়ে নয়নসোনার বাড়ীতে আটকে থেকে সুস্থ হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় খুজে বের করতে পারল না।
নয়নসোনাকে বেশ খুশী দেখাল আর সেটা তার চাল চলনে প্রকাশিত হতে লাগলো।
মেয়েটির খুশী হওয়ার বিষয়টি রবিনের ঠিক বোধগম্য হল না।
নয়নসোনা বাংলা বুঝলেও ভাল বাংলা কথা বলতে পারে না। তাই কথাটা ওকে জিজ্ঞেস করতে পারল না।
নয়নসোনা ওর ঘরে অনেকবার আসলো ওকে বিভিন্ন ভাবে সেবা যত্ন করল। পরদিন নয়নসোনা রবিনকে ধরে ধরে ঘরের বাইরে উঠানের বেঞ্ছে বসাল। দুজন পাশাপাশি বসলো অনেকক্ষণ ধরে। দুজনের অনেকবার চোখাচোখি হল কিন্তু ও বাংলা না জানার ফলে ওদের মধ্যে কোন কথাবার্তা হল না। চোখে চোখেই কেবল ভাবের আদান প্রদান হল।
দ্বিতীয় দিন থেকেই রবিন বেশ সুস্থ হয়ে উঠল। পরদিন সকালে ও নিজের পায়ে হেটে যেতে পারবে বলে বোধ হল। রেঞ্জ অফিসে কাউকে পাঠিয়ে খবরটা জানিয়ে কাল সকালে যেন দুজন গার্ড ওকে নিতে আসে সে ব্যাপারে রবিন নয়নসোনার বাবাকে অনুরোধ করল।
পরদিন সকালে রেডি হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো রবিন। রেঞ্জ থেকে গার্ড আসলেই দেরী না করে রওয়ানা দেবে বলে। কিন্তু বেশ একটু বেলা হওয়ার পরও রেঞ্জ থেকে কেউ এসে পৌঁছাল না।
ওদিকে সকাল থেকে নয়নসোনাকেও দেখা গেল না কোথাও।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল তবুও রেঞ্জ অফিসের কেউ আসলো না। অবাক হল রবিন, অবাক হল নয়ন সোনার বাবা মাও। তাদেরকে বেশ চিন্তিত দেখাল।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর নয়নসোনা ফিরে আসলো বাড়ীতে। ওকে একপাশে ডেকে নিয়ে ওর বাবা মা ওর সাথে কথা বলল। কোন কথা না বুঝলেও ওদের হাবভাবে রবিন পরিষ্কার বুঝল যে, রেঞ্জ অফিস থেকে কোন গার্ড না আসা এবং নয়নসোনার সারা দিন বাইরে থাকার মধ্যে একটা যোগসাযোগ আছে।

ঝর্ণা পাড়ের এই মেয়েটি তার জীবন বাচালো, তাকে শুশ্রূষা করে ভাল করে তুলল, তার জন্য রবিন ভিতরে ভিতরে ওর কাছে কৃতজ্ঞতায় মাথা নোয়াল। কিন্তু আজ রেঞ্জ অফিসের গার্ডদের না আসতে দেয়ার ব্যাপারে নয়নসোনার সংশ্লিষ্টতা রবিনকে ভাবিয়ে তুলল।

সেদিন সন্ধ্যার পর একান্তে নয়নসোনার বাবার কাছ থেকে রবিন জেনেছিল যে, নয়নসোনা তার সঙ্গি সাথীদের দিয়ে রেঞ্জ থেকে আসা দুজন গার্ডের উপর দুধারের পাহাড় থেকে পাথর ছুড়ে তাদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
রাত একটু গড়ালে রবিন নয়নসোনা সহ ওর বাবা মাকে ডাকল।
-কারো কোন আপত্তি না থাকলে কাল আমি নয়নসোনাকে সাথে নিয়ে রেঞ্জ বাংলোতে ফিরবো।
কন্ঠে কোন রকম জড়তা ছাড়া দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাটা বলল রবিন।
নয়নসোনা রবিনের কথা পরিষ্কার বুঝল তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে নিস্পলক নেত্রে রবিনের চোখে তাকাল। তবে অন্য সময়ের মত তার চোখে মুখে সহজাত দুষ্টুমির সে হাসিটা একদম ছিল না।
নয়নসোনার বাবা মা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
মৃদু পদভারে নয়নসোনা ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। তবে কেরসিন বাতির নিষ্প্রভ আলোতে নয়ন সোনার মুখের উপর প্রতিভাত তৃপ্তির হাসিটা কারোরি নজর এড়াতে পারল না।

নয়নসোনাকে তার বাংলোয় নিয়ে যাওয়ার পর এই পাহাড়ী বালিকাকে কি পরিচয়ে সেখানে রাখবে? অফিসের লোকজন কি বলবে? তাদের মুখ বন্দ বরার জন্য রবিন কি করবে ইত্যাদি চিন্তা তার মনে উঁকি দিলেও কি হতে পারে সে চিন্তায় এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট করতে একদম ইচ্ছে হল না রবিনের।