জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -১২।

আপডেট: ৩০ Jul ২০২৩, ১৫:৩১

জীবনের অন্যপিঠ- ১২ 

 

আমির চৌধুরীর গবেষণা ‘মানুষে মানুষে ভেদাভেদের মূল কারণ কি ধর্ম’! বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ভাবে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর তিনি নিজেকে একদম গুটিয়ে নিলেন।
সব ছেড়ে দিয়ে চৌধুরী এষ্টেটে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ভূলতে চায়লেন আমির চৌধুরী। বৃদ্ধ বাবা আবির চৌধুরী ছেলের এহেন পরিস্থিতিতে ব্যথীত হলেও ওকে কাছে পেয়ে খুশীই হলেন।
তখন আবির চৌধুরী ধীরে ধীরে এস্টেটের সব দায়িত্ব আমিরকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। আমিরও সব কাজ কর্মের সাথে নিজেকে নীবিড় ভাবে জড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতে চায়লো।
ওদিকে নীলিমা চৌধুরী আমিরের সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে চাকরী আর ক্যারিয়ার নিয়ে আরো গভীরে ডুব দিতে চায়লো।
তাদের মেয়ে অনিমা বরাবরই মায়ের সাথে থাকতো। আমির চৌধুরী ছেলে অমরকে বারো বছর বয়সে তার বাবার সাথে পরামর্শ করে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে চাচার কাছে পাঠিয়ে দেয়েছিলেন।

কাজের বাইরে আমিরের একাকিত্ব ওর বাবা মার কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক হয়ে উঠলো। আমির সারাদিন চৌধুরী এষ্টেটে ঘুরে বেড়াতো আর বিড় বিড় করে কি সব যেন বলতো। স্বামীর এমন অবস্থায় তার স্ত্রী নীলিমার উদাসীনতায় আমিরের বাবা মা বিশেষ আহত হলেন।
নীলিমার কাছ থেকে ছেলে সম্পর্কে সব শুনে ওদের মনে ছেলের প্রতি যে ভুল ধারনার মেঘ জমেছিল প্রফেসর ডঃ রেবেকা বিশ্বাসের কাছ থেকে সব শোনার পর তা সব কেটে গেল। বরং ছেলের জন্য ওর মা বাবার বুকটা গর্বে ভরে উঠলো।
ডঃ রেবেকা বিশ্বাস লন্ডনের একটা ইউনিভর্সিটি থেকে পাঠানো একটা আমন্ত্রন পত্র আমিরের বাবা মাকে দেখালেন। আমিরকে ওর গবেষনার জন্য সংবর্ধনা দেয়ার আম্নত্রনপত্র।
-আপনারা আমিরের বাবা মা হিসাবে সত্যিই গর্বিত আর আমি ওর সাথে পরিচিত হতে পেরে সত্যি সত্যিই নিজেকে বিশেষ সৌভাগ্যের অধিকারী বলে মনে করি।
ছোট্ট একটা চাপা নিঃশ্বাস টেনে বললেন ডঃ রেবেকা বিশ্বাস।
-মা, আপনার ছেলেকে আরো গভীরভাবে সহযোগিতা করার কোন সুযোগ পেলে নিজেকে ধণ্য মনে করতাম।
ডঃ রেবেকা বিশ্বাস ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে আমিরের বৃদ্ধা মায়ের হাত দুটো ধরে কথাগুলো বললেন।

যাহোক, আমির চৌধুরীর বর্তমান মানষিক অবস্থার কথা চিন্তা করে গবেষনার জন্য সংবর্ধনার দেয়ার ব্যপারটা ডঃ রেবেকা বিশ্বাসের পরামর্শেই আমিরকে জানানো হলো না।
-আমির হয়তো যাবে না সে সংবর্ধনায়, বরং তাতে করে ছিদ্রান্বেষী মহল লন্ডনের একটা ইউনিভারসিটি কর্তৃক সংবর্ধনার কথা বিরূপ ভাবে প্রচার করে বর্তমানে মোটামুটি স্তিমিত হওয়া প্রসঙ্গটা আরো কিছু গল্প বানিয়ে আবার জাগিয়ে তুলবে।
ডঃ রেবেকা বিশ্বাসের কথা আমির চৌধুরীর মা বাবা মেনে নিলেন।

আবির চৌধুরী বছর গড়াতে না গড়াতেই মারা গেলেন। স্বামীর মৃত্যু বোধহয় সহ্য হলো না ওর মায়ের। স্বামীর মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে আমিরের মাও পরোলোকে গমন করলেন।

আমির চৌধুরীর এ ধরণের বিতর্কে জড়িয়ে পড়া এবং ডঃ রেবেকা বিশ্বাসের সাথে ওর সম্পর্কের বিষয়টি কোনদিনই সুনজরে দেখিনি নীলিমা। পরবর্তীতে রেবেকা বিশ্বাসের চৌধুরী এষ্টেটে অবস্থান এবং সর্বপরী তার শশুর শাগুড়ী কর্তৃক রেবেকাকে ওভাবে আপ্যায়ন করাকে বিভিন্ন ছিদ্রান্বেষী মহল যেভাবে অপব্যাখ্যা দিয়ে গল্প বানাতো তা বিনা তদন্তে নীলিমা চৌধুরী বিশ্বাস করতেন।
নীলিমা রাগে দুঃখে অভিমানে আমির আর চৌধুরী এষ্টেটের সব কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।
অনিমাকে তারই এক কলিগের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজের গন্ডিকে অনেক ছোট করে ফেললেন নীলিমা। চোধুরী এষ্টেটের কোন ঘটনায় যেন ওর মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না।
আমির চৌধুরীর ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। তেমন কোন উল্লেখযোগ্য রোগ ছিল না ওর দেহে। কিন্তু আমিরের মনের ভিতরের অবস্থা সবার দৃষ্টিকে বোধহয় এড়িয়ে গেল।
সুস্থ সবল মানুষটি হটাৎ করেই বুকে ব্যথা নিয়ে সজ্জা নিলেন। তার শারীরিক অবস্থাটা একটু স্থিতিশীল করে হার্ট অপারেশানের জন্য বড় কোন হাসপাতালে নেয়ার সুযোগও দিল না।
স্বামীর অসুস্থতা নীলিমাকে তেমন ভাবে দোলা না দিলেও ওর অকাল মৃত্যুটা নীলিমা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলেন না। সবল দেহী আমির যে এত অল্পতেই মারা যেতে পারে তা নীলিমা ঘুর্নাক্ষরেও ও চিন্তা করেনি কখনো।
স্বামীর মৃত্যু সংবাদটা যেন আকাশ ভেঙ্গে তার মাথায় ফেললো। নীলিমা একাকী রাজধানীর বিরাট বাড়ীটার মধ্যে এক মূহুর্তে একদম একা হয়ে গেল।
অনেকদিন ধরেই তিনি একাকী থাকতে অভ্যস্ত। কয়েক বছর হলো অবসর নিয়েছে চাকরী থেকে। মাঝে মধ্যে একটু একাকিত্ব বোধ হতো কিন্তু স্বামীর উপর রাগ আর অভিমান তাকে শক্ত থাকতে সহায়ক হতো।
আজ যে রাগ বা অভিমান করার লোকটিই চলে গেল! এত দিন যা নিয়ে বেচে ছিল, সে রাগ অভিমান কার উপর খাটাবেন তিনি।

অন্ধকার ঘরে একাকী বসে নীরবে অশ্রু সংবরন করতে লাগলেন নীলিমা।
চাকরী বা পারিবারিক জীবনে কত কঠিন সময়ে সিন্ধান্ত নিয়েছে তিনি নিজে, কিন্তু আজ স্বামীর মৃত দেহটা দেখতে যাওয়ার ব্যপারে কিছুতেই কোন সিন্ধান্ত নিতে পারছিলো না নীলিমা।
অনিমা আসলো। ওকে জড়িয়ে ধরে নীলিমা চৌধুরী হাউ মাউ করে কাঁদলেন ছোট্ট শিশুর মত।
-অনিমা তোর বাবা আমাকে ফাকি দিয়ে চলে গেল!
কেউ তার সে কান্না থামাতেই পারলো না। সন্ধা বেলা রামদয়াল আসলো।
-কয়েকদিন হলো অমর এসেছে, আপনি এখনি চলেন চৌধুরী মা। সব যে শেষ হয়ে গেল।
ডুকরে কাদতে লাগলো রামদয়াল।
সে রাতেই চৌধুরী কুঞ্জের রক্ষনাবেক্ষন সম্পর্কে যাবতীয় সব কিছু কেয়ারটেকারকে বুঝিয়ে দিয়ে নীলিমা চৌধুরী রামদয়ালের সাথে রওয়ানা হলেন।
মা আর ছেলে মেয়ের কান্নায় চৌধুরী এষ্টেটের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। কোন কিছুই যেন ওদেরকে বুঝ মানাতে ব্যর্থ হলো। নীলিমা স্বামীর মৃত্যুটাকে কোন রকমে মেনে না নিতে পেরে মূর্ছা গেলেন। তাকে হাসপাতালে স্থানন্তর করা হল।
চোখ মুছতে মুছতে রামদয়াল এসে দাড়ালো।
-চৌধুরী মা, আপনারা এত ভেঙ্গে পড়লে আমি একা কি করে সব সামলাবো। দেরী হয়ে যাচ্ছে, চৌধুরী বাবার লাসের একটা ব্যবস্থাতো করতে হবে।
মা ছেলে দুজনেই বলতে গেলে অপরিচিত চৌধুরী এষ্টেটে। তার উপর আপনজন হারানোর শোকে মুহ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে রামদয়ালের কণ্ঠ যেন ওদের রিক্ত হৃদয়ের উপর যাদুর পরশ বুলিয়ে দিল।
ওরা চোখ মুছে উঠে দাড়ালো।

বাবাকে কবর দিয়ে অমর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে জমিদারীর সব কাজকর্ম বুঝে নিতে লাগলো।
কিন্তু নীলিমা চৌধুরী কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারলেন না।
নীলিমা চৌধুরী কত দিন পর এ বাড়ীতে এলেন। বিয়ের পর বেশ কয়েকবার যদিও তিনি এ বাড়ীতে এসেছেন কিন্তু কোন সময়ই বেশী দিন থাকেনি।
কিন্তু এটায়তো তার বাড়ী, এটাই তার ঠিকানা। তবু কেন যেন সে ভাবে দাবীটা তিনি করতে পারছেন না মন থেকে। মনে হচ্ছে এ বাড়ীর সবাই সবকিছু তার দিকে কটাক্ষ করে তাকাচ্ছে। স্বামীর মৃত্যুতে তার হৃদয়টা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলেও কারো কাছেই তা প্রকাশ করতে পারছে না।


Read More