জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'মৃতের সন্ধানে' পর্ব- ১৩

আপডেট: 2022-06-19 14:06:15

অমৃতের সন্ধানে- ১৩ 

 

মেঘমুক্ত জ্যোৎস্না ধোয়া রাতে নির্জন পুখুর ঘাটে বসে এসব কথা ভাবতে ভাবতে মানিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালো। বুকটা যেন খালি হয়ে গেল। নিজেকে হালকা বোধ হল।

-আমি আপনার জায়গায় হলে নিজের একটা হাসপাতাল বানাতাম।

বেলাল সম্পর্কে শিউলির জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের উত্তরটা এড়িয়ে মানিক যেন প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়লো।

শিউলি কিছুটা অবাক হলো। তাকালো ওর দিকে।   

-মানিক প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছে কেন! বেলালের প্রসঙ্গে বলেই কি? ভাবল শিউলি।    

বাস্তবটা নিরেট কঠোরতা মানিকের কাছে। তায় ও স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের মাদকতায় ও তৃষ্ণা মিটাতে চাই।          

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস টেনে মানিক আবার শুরূ করলো – আপনাদের মত হলে, একদম গ্রামের গভীরে যেখানে সভ্যতার কানাকড়ি পৌছায়নি এমন একটা জায়গায় বড় একখন্ড জমি কিনে ওখানে বিশাল একটা হাসপাতাল গড়তাম আমি। ঐ অঞ্চলে যে যে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী ঐ ধরনের রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম সেখানে। সেইসাথে বাচ্চাদের জন্য প্রাইমারী স্কুল আর বয়স্কদের শিক্ষার জন্য নৈশ স্কুল খুলতে পারলে আরো ভাল হতো।  

বেশ গুছিয়ে কথা বলে মানিক। ওর কথাগুলো এমন যেন কথা দিয়েই ছবি আকে। চিন্তার সাথে হৃদয়টা লাগালে বোধহয় এমনিই হয়। ভাবল শিউলি।                                             

-সে হাসপাতালে দূর দুরান্ত থেকে কত মানূষ আসবে বুক ভরা আশা নিয়ে। সব রোগের তো আর চিকিৎসা হয় না। কিন্তু ওরা তা বুঝবে কি করে। রোগীদের একমাত্র চাহিদা রোগের চিকিৎসা, সে রোগের চিকিৎসা আছে কি নেই তা ওরা বুঝতে চায় না। যন্ত্রনায় কাতর মানুষ অবুঝ হয়। অবুঝদের চাওয়ার মধ্যে একটা বিশেষত্ব আছে। এটা যেন ছোট্ট শিশুর আবদার মায়ের কাছে। এ ধরনের মানুষদেরকে কখনো নিরাশ করে খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না। আশা দিয়ে উষ্ণতা দিয়ে যন্ত্রনা ভুলতে সাহায্য করবেন।

মানিক ওর মুখটা শিউলির মুখের কাছে এনে ফিস ফিস করে বললো -মিথ্যে আশা হলেও তা দিবেন। সেটা যদি যন্ত্রনাকাতর মানুষকে কিছুটা যন্ত্রনা ভূলতে সাহায্য করে তবে সে আশা দিতে একটুও কুণ্ঠা করবেন না।

চারদিক কেবল নিস্তব্দতা। বক্তা শুধু একজনই, আর সবাই শ্রোতা।   

মানিক বলেই চলেছে, মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম মন খালি করে হৃদয়ের সব কথা সকল ভাবনা উজাড় করে দেয়ার একজন মানুষ ও পেয়েছে।

-সারাদিন রোগী দেখা আর অন্যান্য সব তদারকি করার পর পড়ন্ত বিকেলে এলোকেশে ক্লান্ত পা দুটো ফেলতে ফেলতে আগামী দিনের কাজের চিন্তায় ডুবে ঘরের পথে এগিয়ে যাবেন আপনি। পড়ন্ত বেলায় ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরবেন। দেহটা এলিয়ে দিবেন বিসানায়। ক্লান্তির পরশ তখন নিজে হাতে আপনার দেহ আর মন থেকে যা কিছু পার্থিব যা কিছু কৃত্রিম তার সবকিছু মুছে দেবে। আপনি হয়ে উঠবেন একান্ত আপনার মানুষ। আপনি হয়ে উঠবেন অসাধারণ অপরূপা, যেন প্রকৃতির কন্যা। মনের সবটুকু মাধুরী নিংড়িয়ে শিল্পীর আঁকা ছবির মত দেখাবে আপনাকে। 

-তবে হ্যে, আপনাকে প্রকৃতির সাথে রং মিলিয়ে এক এক ঋতুতে একেক রংএর শাড়ী পরতে হবে। প্রকৃতির সাথে মিশে একাকার হতে হবে আপনাকে। প্রস্তানরত দিনমনি তার শেষ কিরণ দিয়ে, মায়া মাখা বাতাসের হাত আর ঠোট দিয়ে আপনাকে আদরে আদরে ভরে তুলবে।                             

-কোন একঘেয়েমীতা আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না। যা কিছু নিজের তার সবকিছুই চাপা পড়ে থাকবে। আপনার নিজের কোন কিছুই আপনাকে পীড়া দেয়ার ফাঁক খুঁজে পাবে না।                  

-ওই বিশাল কমপ্লেক্সে ঢুকার জন্য বড় একটা গেট থাকবে। গেটটার দুধারে দুটো শিউলি ফুলের গাছ থাকবে। ফুলগুলো ফুটে সেজে গুজে অপেক্ষা করবে সারা রাত ধরে। শিশির ভেজা ভোরে যন্ত্রনা লাঘবের উদ্দেশে দূরদুরান্ত থেকে আসা মানুষগুলো যখন গেটটা দিয়ে প্রবেশ করবে, তখন সারা রাত জেগে জেগে অপেক্ষা করার পর ক্লান্ত হয়ে ফুলগুলোর অনড় দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকবে। কেউ হয়তো ওদেরকে দেখবে না, পায়ে মাড়িয়ে চলে যাবে। তাতে কিছু আসে যায় না। প্রকৃত দানতো প্রতিদান চায় না।                     

একটু থেমে ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস টানলো মানিক- সেবার প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে নিঃস্বার্থতা! কি স্বর্গীয় স্বাদ!

তারপর অনেকটা স্বগতঃ কণ্ঠে বললো -বেচারী সারা রাত ধরে সেজেগুজে নিজের সব টুকু রূপ আর রস নিংড়িয়ে ভ্রমরের আশায় বসে রইলো, রাতের আধারের ঠেলে ভ্রমর এলো না, আর দিনের প্রথম আলো ফুটার আগেই ওর প্রাণপাখীটা টুপ করে উড়াল দিল। নিয়তির কি খেয়াল! দিনের আলোতে ভ্রমর ঠিকই এলো, শূন্য ডাল পাতায় ওর ভালবাসার পরশ বুলিয়ে দিল। আর শিউলির অসাড় দেহটা মাটিতে লুটিয়ে রইলো।   

মানিক বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে বুকটা একটু হালকা করে বললো –জানেন, কিছু কিছু জীবন বোধহয় জন্ম নেয় শুধু জ্বলার জন্য। ওদেরকে জ্বলতে দেখায় যেন স্রষ্টার আনন্দ!                          

একটু থামলো ও। কি যেন একটা চিন্তা করে নিল। তারপর খুব হালকা ভাবে বললো - যার কাজ সেই করূক।  

-আপনার হাসপাতালটার জায়গা হবে একটা নদীর পাড়ে। না, কোন বড় দিঘি হলে কিন্তু চলবেনা। দিঘির জল হল আটকা, মুক্ত বিহংগের মত নয়। সব সময় কিনারা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরে আসে, তাতে কিনারা ভেদ করার আনন্দ বা দূঃসাহসিকতার স্বাদ কোনটায় পাওয়া যায় না। সে জীবনতো গন্ডিবদ্ধ। আর নদীর জল সেত মুক্ত বলাকা, সমুদ্র মহাসমুদ্রের সাথে ওর যোগাযোগ। ও বিধাতার আইনে চলে, নিজ গতি নিজ ছন্দে বয়ে চলে।

 -সেরকম একটা নদীর পাড় ঘেসে হবে আপনার হাসপাতাল। লম্বা লম্বা বিশাল শিড়ি দিয়ে ঘাটটা বাধানো থাকবে। আপনার শোয়ার ঘরের গা ঘেঁসে লম্বা লম্বা সিড়িগুলো গিয়ে নামবে নদীতে। তবে অন্য কারো জন্য নয়, ওই ঘাটটা শুধু আপনার নিজের ব্যবহারের জন্য। সারা দিনের কর্মক্লান্তির পর আপনার ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়া শরীর মন যখন কিছু একটা খুজবে তখন গিয়ে বসবেন সেখানে। বাতাস নদীতে ডুব দিয়ে ঠান্ডা পরশ এনে আপনার চোখে মুখে সারা দেহে বুলিয়ে দেবে। রাতের আঁধারে নিমিজ্জিত নদী, গাছ পালা, পাখী সবাই নিজ নিজ সুর মুর্ছনায় ডুবে থাকবে। আলো আধারীর খেলায় সবকিছু অতি প্রাকৃত স্বপ্নীল মনে হবে। এমনি একটা পরিবেশে না বলা কথগুলো মুখ খুজে পাবে।          

-প্রকৃতির সাথে কথা বলবেন, সব কথা সব প্রশ্ন করবেন। যে কথা যে প্রশ্নের কথা আপনি অন্য কাউকে বলতে পারেননি। প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে নিজেকে খুজবেন। মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা সাত সমুদ্রের ওপারে থাকা আপনার মনের রাজপুত্রকে খুজবেন। সে বাতাসের কাঁধে চড়ে জলের বাশি বাজাতে বাজাতে আসবে। হৃদয় নিংড়িয়ে ভালবাসা দেবে। আলো আধারীর নৃত্যে আর নিস্তব্দতার সুরে নদীর দিকে তাকিয়ে আপনি যা কল্পনা করবেন তায়ই আপনার চোখের সামনে উপস্থিত হবে।

শিউলি স্বপ্ন ভংগের মত জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে মানিকের দিকে তাকালো।

মানিক ওকে নিশ্চিত করতে ওর চোখে চোখ রেখে একটু স্মিত হেসে দুচোখের একটা পলক ফেলে বললো- হ্যে, যা মনে মনে ইচ্ছা করবেন চোখের সামনে তায় হাজির হবে।                                                     

অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে শিউলি মানিকের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওকে যেন কেমন অচেনা মনে হলো শিউলির কাছে।                                  

-একটা নৌকা বাধা থাকবে ঘাটে। খোলা, যাতে করে চারিদিক দেখা যায়।

-আপনি অপেক্ষা করবেন তার আগমনের। পাতা পড়ার শব্দে চমকে উঠে তাকাবেন।

-অজানা অনিশ্চিয়তার অপেক্ষার একটা অনন্য রূপ আছে, স্বাদ আছে যা নিঃশ্বেষ হয় না। পেয়ে যাওয়ার মধ্যে অপেক্ষার সমাপ্তি। প্রাপ্তির আনন্দের স্থায়ীস্ত নেই, সেটা ক্ষনস্থায়ী। আর অপেক্ষার স্বাদ স্থায়ী, অপেক্ষার প্রাপ্যটা অপেক্ষাকারীর দেহ মনে লেপটে থাকে। যত সময় বয়ে যায় আগ্রহ বাড়তে থাকে। প্রবল আকাঙ্ক্ষা কখনই অগ্রাহ্য হয় না। প্রাপ্যটা নীরবে নিথরে এসে ছুঁয়ে যায়, সঙ্গ দিয়ে যায়, ভালো বেসে যায়। যে মন ভালোবাসে কেবল সেই বুঝতে পারে অন্য কেউ নয়।                                                                

-সেত আসবেই তা যত রাতই হোক। তারপর আপনারা দুজন নৌকটাতে উঠবেন। নৌকায় কোন বৈঠাও নেই মাঝিও নেই। আপনাদের কোন নির্ধারিত গন্তব্যও নেই। সামনে পিছনে কোন দিকে যাওয়ার তাড়না নেই। আপনারা হয়ে উঠবেন জলরাশির সন্তান। নিরূদ্দেশ যাত্রা আর অবুঝ প্রেমের মাদকতায় আপনারা মুহ্যমান। প্রথিবী ঘুমিয়ে শুধু আপনারা দুটি প্রাণী ছাড়া, আর আকাশ আর তারারা শুধু চেয়ে আছে।

শিউলি নির্বাক হয়ে ওর দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে ওর কথা শুনছিলো।

বাতাস মানিকের অগোছালো ছুলগুলো এলোমেলো করছিলো। শিউলি ওর বুকের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়িয়ে ওর হাতটা দিয়ে ঠিক বাতাসের মত করে মানিকের এলোমেলো চুলগুলোর ভিতর ওর আঙুল সঞ্চালন করতে মন চাইলো। 

মানিক চুপ করে কি যেন একটা ভাবলো।

-হাসপাতালের একটা নামতো দরকার। কি নাম দেয়া যায়।

একটু ইতস্ততঃ করে ও একটু ভাবলো।

- নামটা না হয় বাদই থাক কি বলেন, আপনার জীবন সঙ্গীর কাছ থেকেই না হয় জেনে নেবেন।      

কথাটা বলে মানিক নির্দ্বিধায় শিউলির গায়ে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্দ করলো।  

শিউলি একটুও বাধা দিল না। ইতস্ততঃ বোধও করলো না।   

-কি ভাবছে মানিক? হয়তো বেলালের কথা- ভাবলো শিউলি। কি ভাবছে ও বেলাল সম্পর্কে? প্রতিপক্ষ!

কথাটা চিন্তায় আসতেই শিউলি নিজেকেই যেন একটু ধমক দিল। - মানিককে সে এত সংকীর্ণ পরিসরে কি করে ভাবতে পারলো!   

শিউলি বুঝলো মনে মনে ও নিজেই মানিককে বেলালের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাড় করিয়েছে। 

 -মানিকের কোন পতিপক্ষ হয় না, কেবল মাত্র ও ছাড়া, মানিক অনন্যসাধারণ। ভাবলো শিউলি। 

মানিকের মাথাটা ওর কোলের উপর টেনে নিয়ে ওর চুলের ভিতর আঙুল বুলিয়ে দিতে লাগলো।

চাঁদটা ঠিক মাথার উপর। সব কিছুর ছায়া যেন নিজ নিজ দেহের সাথে মিশে একাত্ম হয়ে রয়েছে। সবই নিজ নিজ রাজ্যে বিচরণ করছে।