জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'জীবনের লক্ষ্য'।

আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৪৫

জীবনের লক্ষ্য

প্রকৃতি বোধহয় মানুষের মন বোঝে আর সেভাবেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের দ্বারা সৃষ্টির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে।
গতকাল মধ্য রাতে তার বিদেশে অধ্যায়নরত ছেলে মিন্টুর কাছ থেকে ফোনটা পাওয়ার পর থেকে মিসেস ব্যাপারী কেন জানি একদম অন্য মনস্ক হয়ে রয়েছে। জীবনের অর্থটাই যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে তার কাছে।
ছেলে ফাইনাল সেমিস্টারে, তাই পড়াশোনার খুব চাপ। টেলিফোন করার সময়ই পায় না। ছেলেকে টেলিফোন করলে সে বিরক্ত হয়, তাই আজকাল ওকে টেলিফোন করতেও অজানা একরকম দ্বিধা বোধের সৃষ্টি হয়েছে মায়ের মনে।

-মা কথা বল।
প্রায় মাস খানেক পর গতকাল মাঝ রাতে খোকার টেলিফোন। ঘুম ভেঙ্গে সেল ফোনে ভেসে ওঠা ছেলের নামটা দেখে খুব উদগ্রীব হয়ে উঠল মিসেস ব্যাপারী। কথাটুকু কোন রকমে বলেই খোকা ফোনটা একটি মেয়েকে দিল।
-মা আপনি কেমন আছেন?
মুখস্ত করা ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাই কোন রকমে কথাটুকু শেষ হতেই খোকা ফোনটা নিয়ে নিল।
-মা, ওর নাম মেরি, এ দেশের মেয়ে, আমার সাথে পড়ে, তুমি অনুমতি দিলে আমি ওকেই বিয়ে করব। তাহলে আমি তাড়াতাড়ি এদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে এদেশেই ভাল চাকরী করতে পারব।
বাকি কথা পরে বলব বলে মিন্টু লাইনটা কেটে দিল।
মিসেস ব্যাপারী ঘড়িতে দেখল তখন রাত একটা। ওদের ওখানে বোধহয় লাঞ্চ ব্রেক।
মাকে টেলিফোন করার সময় মিন্টু কেবল ওর নিজের ঘড়িটা দেখে, মায়েরটার কথা চিন্তা করে না। সেটা ঠিক আছে, মায়ের উপর ছাড়া এ দুনিয়াই ছেলের এরকম অধিকার আর কার উপর থাকবে!
ভাবল মিসেস ব্যাপারী।
বাকি রাতটুকুতে আর ঘুম হল না মিসেস ব্যাপারীর। এর পরপরই বিদ্যুৎ চমকিয়ে বিকট শব্দে ধারে কাছে কোথাও বাজ পড়ে কারেন্ট অফ হয়ে সবটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হল। শুরু হল বৃষ্টি।

গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করা মরিয়ম বিবি এখন মিসেস ব্যাপারী নামে পরিচিত হয়ে এই মফস্বল শহরের এক নম্বর ট্রেডিং ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

শ্রাবনের মাঝামাঝি গত মাঝ রাত থেকে শুরু হয়ে বৃষ্টি একই ভাবে বিরামহীন ভাবে ঝরছে। শ্রাবন মাসে হিসেবে বৃষ্টি হওয়ার কথা কিন্তু সব শ্রাবনে এ রকম বৃষ্টি আজকাল হয় না। সত্যি বলতে আগেকার তুলনায় বর্তমানে বৃষ্টি অনেক কম হয়। তাইতো খাল বিল ডোবা সব দিনে দিনে শুখিয়ে ভরাট হয়ে গিয়েছে। আর মানুষজনও আজকাল ঘরবাড়ীর ভিতও তেমন উঁচু করে তৈরি করে না।

মিসেস ব্যাপারী এ ব্যাপারে পুরনো আমলের ধ্যান ধারনায় রয়ে গেছে, তাই প্রায় পনেরো বছর আগে তৈরী তার তিলতলা অফিস বিল্ডিঙটার ভিত্তি রাস্তা থেকে প্রায় পাচ ফুট উঁচু করে তৈরী করেছে। শহরের এক প্রান্তে প্রায় পাচ একর জমির সবটায় অনেক মাটি ভরাট করে আশ পাশ থেকে উঁচু করে পাচিলের বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে সামনের দিকে অর্থাৎ রাস্তার সাথে লাগোয়া করে তার তিন তলা অফিস সহ গোডাউন গ্যারেজ ইত্যাদি আর পিছন দিকে থাকার জন্য বাড়ী আর বাগান।
গত রাত থেকে শুরু হওয়া অবিরাম বৃষ্টি সবাইকে কর্ম বিমুখ করে ঘর বন্দি করেছে।
দুপুর প্রায় গড়িয়ে গিয়েছে কিন্তু ঘড়ি না দেখলে বেলা কত খানি গড়িয়েছে বোঝার উপায় নেই।
মাঝ বয়স পার করা সফল ব্যবসায়ী মিসেস ব্যাপারী তিন তলায় তার কাচ আঁটা অফিসে বসে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে যেন হারিয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই রাস্তা গুলো পানিতে ডুবে খালে পরিণত হয়েছে। আশে পাশের অনেক বাড়ীর মেঝেতে পানি উঠেছে। মিসেস ব্যাপারীর কমপ্লেক্সটা কোন রকমে নাক উঁচিয়ে টিকে আছে।

জীবনের অনিশ্চয়তা বোধহয় সব জীবনে চালিকা শক্তি জুগিয়ে সব বাঁধা অতিক্রম করে সামনে চলার প্রেরণা দিয়ে জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। কথাটা আপাতবিরোধী মনে হলেও এটাই সত্যি। কিন্তু সেটা অনুভবের বিষয়, ঠিক অংক দ্বারা প্রমাণ করা যায় না।
মিন্টু ছোট কালে তার বাবা মধু ব্যাপারীকে হারিয়েছিল। তখন তার বয়স বড় জোর দুই বছর। সে বয়সটাতে মানুষের মধ্যে চিন্তা শক্তির উদ্ভব হয় না, ভূত ভবিষ্যৎ, ভাল থেকে খারাপ বা ঠাণ্ডা থেকে গরমের পার্থক্য করার জ্ঞান তখনও জন্মায় না। তায় দুধের বাচ্চা শিশু মিন্টু সেদিন কি হারিয়েছিল তখন তা বোঝার মত জ্ঞান তার মধ্যে জন্মায়নি।
মরিয়ম বিবি অকালে স্বামী হারিয়ে তার শিশু সন্তানকে নিয়ে তার সামনেটা একেবারে অনিশ্চিত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। তার উপর প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজনদের নেতিবাচক মন্তব্যে সে অন্ধকার যেন আরো ঘনীভূত হল।
কিন্তু সামনের পথ মরয়ম বিবিকে মাড়াতেই হবে। তা যতই অনিশ্চিত আর অন্ধকারাচ্ছন্ন হোক না কেন!
ছেলেকে বাচিয়ে রেখে মানুষ করতে হবে। অন্ধকারে অচেনা অজানা পথ চলার জন্য বাতি তাকেই জ্বালাতে হবে। সে কথা ভাল ভাবে অনুধাবন করল মরিয়ম বিবি।

মধু ব্যাপারী তার নিজ গ্রাম আর সে অঞ্চল থেকে বিভিন্ন মালামাল কম দামে কিনে শহরে নিয়ে বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করত। খুব বিশ্বাসী মানুষ ছিল মধু ব্যাপারী, আর সেটাই ছিল তার ব্যবসায়িক মূলধন। তার সে মূলধনের উপর নির্ভর করে অঞ্চলের চাষিরা তাকে বাকিতে মালামাল সরবরাহ করত। মধু সেগুলো শহরের আড়োতে সরবরাহ করে টাকা পেয়ে চাষিদের সব দেনা শোধ করে দিত।
স্বামীর ব্যবসার ব্যাপারে তার স্ত্রী মরিয়ম সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করত। তাছাড়া যাবতীয় টাকা পয়সার হিসেব সেইই রাখতো, ফলে চাষিরা সহ আড়দার সবার সাথেই মরিয়ম বিবির পরিচয় ছিল।
বিধবা মরিয়ম বিবি শিশু পুত্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় অকালে স্বামী হারানোর শোকটা চাপা দিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসার হাল ধরল।

একই গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারের মেয়ে মরিয়ম, গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর পরই পিতৃহীন যুবক মধুর সাথে তার বিয়ে হয়। ভিটে বাড়ী ছাড়া মধুর আর কোন সম্পত্তি ছিল না। অল্প লেখাপড়া জানা মধু, ওই স্কুলেই দপ্তরীর কাজ করত। মধুর সরলতা আর বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়েছিল মরিয়ম।
মধুর পিছনে তাকানোর মত যেমন কিছু ছিল না তেমনি সামনেটাও অনিশ্চিত আর অন্ধকার ছিল।
কিন্তু সরলতার এ এক অনন্যতা। মধু বর্তমান অর্থাৎ যায় দিন নিয়ে জীবন কাটাত, সামনে তাকিয়ে না, তাই সামনের অন্ধকারাচ্ছন্ন অনিশ্চয়তা ওকে একদম স্পর্শ করত না। সরলতার এই রূপই মরিয়মের মন কেড়েছিল।
মধুর জীনটা ছিল একদম অগোছালো, সেটা তার জীবন সম্পর্কে উদাসীনতায় আর পোশাক আশাকে পরিষ্কার ভাবে প্রতিভাত হত। মধুর প্রতি মরিয়মের আকর্ষিত হওয়ার সেটাও একটা কারণ ছিল।
প্রকৃতই আগোছাল জীবনের একটা আকর্ষণ আছে। এ ধরনের জীবন অনেকটা সোজা সরল রেখাই না চলে নিজেস্ব ছন্দে আঁকাবাঁকা হয়ে বয়ে চলা শীর্ণ নদীর মত। যেন আত্মভোলা কোন এলোকেশী লাস্যময়ী গ্রাম্য বালিকা, নিজের ভালবাসায় নিমগ্ন এলোমেলো চুলে নানা বর্ণের বুনো ফুল গুজে হেলতে দুলতে নির্জন প্রান্তরের বুক চিরে হেটে চলেছে।
নদীর বাঁকগুলো মানুষকে আকর্ষণ করে। মানুষ বোধকরি নিজের জীবনের বাকের সাথে নদীর বাঁকের মিল খুঁজে পায়।
বিয়েটা মরিয়মের নিজের পছন্দের তাই মধুকে নিজের পায়ে দাড় করানোর জন্য ওই ব্যবসাটা বেছে নেয়ার জন্য সেই মধুকে পরামর্শ দিয়ে বিয়ের প্রথম দিন থেকেই স্বামীর পাশে দাড়িয়েছিল। আর প্রথম দিন থেকেই জীবনের বাস্তবতার সাথে একাত্ম হয়ে ওরা স্বপ্ন দেখত।
নব বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর প্রেম ভালবাসার জন্য বর্তমান যুগের মধুচন্দ্রিমার কোন আয়োজনের প্রয়োজন এদের ছিল না। সকালে মধুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কৃষকের ক্ষেতে পাঠানো, তারপর একটু বেলা উঠলে তার জন্য সেখানেই সকালের নাস্তা নিয়ে যাওয়া, তারপর সব সামগ্রী গাড়ীতে লোড করার দৃশ্য দেখা বা টুকটাক সাহায্য করা আর মাঝে মাঝে কাছের মফস্বল শহরে আড়তে যাওয়া এ সবের মধ্যেই মরিয়ম স্বামীর সাথে প্রেম ভালবাসা নেয়া দেয়া করত।
বিয়ের এক বছরের মাথায় মধু একটা মটর সাইকেল কিনল যাতায়াতের সুবিধার জন্য। মটর সাইকেলটি মধুকে যে গতি দিল মুলত তার বদৌলতেই ব্যাবসার উন্নতি ত্বরান্বিত হল।
বিয়ের দুই বছর পর মরিয়মের কোল আলো করে ছেলেটা যখন আসলো তখন প্রকৃতঅর্থে ওরা জীবনকে পরিপূর্ণ ভাবতে শুরু করল।
ছেলেটা জন্মানোর কিছু দিন আগেই মধু তার বেড়ার ঘরটা ভেঙ্গে পাকা ঘর তৈরি করল।

কিন্তু জীবনে গতি বাড়িয়ে জীবনের অনিশ্চিত অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতকে আলোকিত করার সহায়ক সে মটর সাইকেলই যে ওদের জীবনটা থামিয়ে দেবে তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল!
সকালে মটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে দুপুরের মধ্যে মধু যে লাস হয়ে ফিরবে তা কি কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল!
এরকম আচমকা দুর্ঘটনার ফলে মরিয়ম একদম ভেঙ্গে পড়ল। জীবনের সামনের দীর্ঘ পথ একেবারে অনিশ্চিত অন্ধরারাচ্ছন্ন হয়ে গেল।
মানুষের আবেগ অনেকটা কর্পূরের মত, সময়ের সাথে সাথে তা কমতে থাকে। স্বামী হারানোর পর সবাই ছুটে আসলো। প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনেরা নিজেদের বাড়ি থেকে খাবার এনে ওদেরকে খাওয়াল কয়েকদিন। পিতৃহারা শিশু মিন্টুকেও কোলে তুলে নিয়ে ওর কান্না থামাল।
মরিয়মের বাবা মা ছুটে আসলো, থাকলো ওদের সাথে বেশ কিছু দিন। বাবা মা ওদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা আলোচনা করল নানা ভাবে।
-মধু অকালে চলে গেল, সেই তো একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল। আর মটর সাইকেলটাই ওদের ব্যবসাটা ধরে রাখা আর উন্নতির একমাত্র সহায়ক ছিল। মধুও নেই আর এক্সিডেন্ট হওয়া অচল মটর সাইকেলটা পুরোপুরিই বিকল। ভাল থাকলেও কোন লাভ হত না, চালানোর কেউ নেই।
-কি করা যায় বলত? আমিতো আর মরিয়মের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। কি করে চলবে ওর বাকি জীবন! আমি না হয় থাকলাম ওর সাথে, কিন্তু সংসার চলবে কি করে? আর মিন্টুর ভবিষ্যৎই বা কি!
বাবার কথার উত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে কথাগুলো ওর মা বলল।
তারা উদাস হয়ে বসে থাকা মরিয়মের পাশে বসেই আলাপ আলোচনা করছিল। আর তার সব কিছুই মরিয়মের কানে যাচ্ছিলো।
-মধুতো চলে গেল, ইস বাচ্চাটা যদি না থাকতো!
মায়ের মন্তব্য মরিয়মের কানে যেতেই ও যেন চমকে উঠে সজাগ হয়ে নড়ে চড়ে বসল।
দু বছরের হাটি হাটি পা পা করা ছেলে মিন্টুর কান্নার শব্দে সম্বিত ফিরল মরিয়মের। মিন্টু পাশেই বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মটর সাইকেলে উপর উঠতে চেষ্টা করতে যেয়ে পড়ে ব্যথা পেয়ে কেঁদে উঠলো।
মরিয়ম তড়িৎ গতিতে দৌড়ে গিয়ে মিন্টুকে উঠাল।
-আমি মটর সাইকেলে চড়ব।
মিন্টু অল্প অল্প কথা বলতে শিখেছে। বাবার সাথে অনেকবার মটর সাইকেলেও উঠেছে আর সেই অভ্যাস বসত ও বায়না করছে।
-কিন্তু কি করবে মরিয়ম? একেতো মটর সাইকেলটা খারাপ হয়ে আছে, উপরন্ত কে চালাবে সেটা!
-মা, তুমি আমাকে মটর সাইকেলে চড়াও।
বায়না করল মিন্টু।
-ছেলে কি তার মাকে মটর সাইকেলে চড়াতে বলছে! ওকি বুঝতে পেরেছে যে ওর বাবা বেচে নেই! আর তাই সেটা মেনে নিয়ে ওর মাকে মটর সাইকেলে উঠানোর জন্য বায়না করছে!
-এ পরিস্থিতিতে মিন্টুর একমাত্র ভরসা ওর মা!
কথাটা ভাবতেই মরিয়মের মধ্যে একটা তড়িৎ ঝলক বয়ে গেল।
মাস খানেক মেয়ের সাথে থেকে মরিয়মের বাবা ওর মাকে রেখে চলে গেল।
মরিয়ম ধীরে ধীরে তার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কৃষক আর আড়তদারদের সাথে যোগাযোগ করে ব্যবসা আবার শুরু করার কথা জানালো। সবাই কম বেশী সন্দেহ প্রকাশ করলেও তার এ উদ্যোগের প্রতি সহানুভূতি জানাল।
ছোট কাল থেকেই সাইকেল চালিয়ে মরিয়ম তার স্কুলে যাতায়াত করত আর সে ভাবেই সকালে সাইকেল চালিয়ে কৃষকদের ক্ষেতে যাতায়াত শুরু করল সে। মিন্টুকে মায়ের কাছে রেখে সকালে বেরিয়ে সব কাজ সেরে আড়ত থেকে টাকা পয়সা নিয়ে বাড়ী ফিরতে রাত হয়ে যেতে লাগলো মরিয়মের।
-লোকাল বাসে করে শহরে যাতায়াত, তাই সময় বেশী লাগে। মায়ের প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম বলল।
-মা আমি ভাবছি মটর সাইকেলটা মেরামত করে নিয়ে মধুর মত আমি ওটাই চালাব।
মেয়ের কথাই মা একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। কিন্তু সে জানে মেয়ের জেদের কথা, একবার যেটা মাথায় ঢুকবে সেটা ও করেই ছাড়বে।

জীবন ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল।
ব্যবসা একটু দাড়ালেই মরিয়ম মিন্টুর পড়াশোনার কথা চিন্তা করে প্রথমে গ্রামের বাড়ী ছেড়ে শহরে বাড়ী ভাড়া নিল। তার পর বড় একটা জায়গা কিনে খোলামেলা একটা বাড়ী করল সেখানে।

তার ব্যবসা এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশ জন কর্মকর্তা কর্মচারী ওর অধীনে চাকরী করে। মরিয়ম শহরের অফিসে বসে। গ্রাম থেকে মালামাল সংগ্রহের জন্য লোক নিয়োগ দিয়েছে। তাদের সবার জন্যই একটা করে মটর সাইকেলও কিনে দিয়েছে। এছাড়া অফিসের জন্য আলাদা গাড়ি, ডেলিভারি ট্রাক আর নিজের যাতায়াতের আলাদা জিপ কিনেছে মরিয়ম।
শহরে বড় অয়ারহাউজ তৈরি করে সেখানে সব কিছু মজুদ করে প্রসেস করে বড় বড় শহরে সেগুলো নিয়মিত সরবরাহ করে তার কোম্পানি।

একমাত্র ছেলেকে ভাল লেখাপড়া শিখিয়ে বড় মাপের মানুষ হওয়ার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছে।
এখন লেখাপড়া শেষ করে ছেলে সেখানেই ওদের একজন হয়ে থাকতে চায়। এতে কোন অস্বাভাবিকতা আছে বলে কোন যুক্তিতে প্রমান করা যাবে না। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে ছেলের এই প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করে সে কেন উদাস হয়ে যাচ্ছে তার উত্তর মরিয়ম কিছুতেই খুজে বের করতে পারছে না।
-কেন মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টি না থেমে সব ডুবে ভেসে গেলেও যেন তার কোন ভয় বা চিন্তা নেই? একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ আলোকিত করে তার জীবনের সব অনিশ্চয়তা দূর করার পর কেন নিজের সব কিছু এমন অনিশ্চিত অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে মরিয়মের!
-জীবনটা কি রিলে রেসের মত! মধু যে ব্যাটনটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নিল, সে ব্যাটনটা মরিয়ম একাই সব দুর্গম পথ অতিক্রম করে মসৃণ আলোকিত পথে এসে ছেলের হাতে তুলে দেয়াই কি তার জীবনের উদ্দেশ্য!
-তাহলে মরিয়ম কি জীবনের লক্ষ্য অর্জন করেছে?
-মধুকে খুব মনে পড়ছে মরিয়মের। সে পাশে থাকলে বোধহয় এই শূন্যতা থাকতো না। কিন্তু থাকলেই কি বা হত, চিরকাল তো থাক্ত না! একদিন না একদিন একজন অন্য জনকে রেখে চলে যেতেই হত!


Read More