জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'স্টেশান মাস্টার'।।

আপডেট: ০৮ অগাস্ট ২০২২, ১৬:৫০

স্টেশান মাস্টার

 

পাহাড়ী এলাকা। ছোট একটা রেল স্টেশানকে ঘিরেই একটা ছোট্ট বাজার আর পাহাড়ের ভিতরে ভিতরে বিচ্ছিন্ন ভাবে গড়ে ওঠা বসতি নিয়েই এ অঞ্চল।
পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া রেল লাইনটা প্রায় দুশো কিলমিটার দূরে অবস্থিত সমুদ্র সৈকতের সাথে যুক্ত হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষদের বিশেষ দেন দরবারের প্রেক্ষিতে একটা সাইড লাইনের এই ছোট্ট স্টেশানটা।
এখানে দিনে কেবল দুটো লোকাল গাড়ী থামে। একটা আপ আর একটা ডাউন। আর মেইল ট্রেনগুলো ভেপু বাজাতে বাজাতে চলে যায়।

জন বিছিন্ন এই স্টেশানে পোস্টিং হল সদ্য চাকরীতে যোগদান করা মাহিমের।
লাল টিনের দোচালা ছাউনির নিচে একদিকে অর্ধেকটা অংশ জুড়ে সামনে এক চিলতে খোলা বারান্দা সহ স্টেশান মাস্টারের অফিস ঘর। বাকি অংশ ফাঁকা, সেখানে যাত্রীদের বসার জন্য দুসারি লোহার চেয়ার। স্টেশান মাষ্টারের অফিসের মধ্যেই টিকিট ঘর, যাত্রীদের বসার স্থান থেকেই গ্রিলের জানালার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে সবাই টিকিট ক্রয় করে।
স্টেশানটার পিছনেই দু কামরা ওয়ালা স্টেশান মাষ্টারের জন্য বাসস্থান আর একই সারিতে মাঝে কিছুটা ফাঁকা যায়গা রেখে স্টাফদের জন্য লাগালাগি করে আরো তিনটে বাসা।
পশ্চিম মুখী স্টেশানের পিছনে দুশো আড়াইশো গজের মধ্যে ছোট্ট একটা বাজার। যেখানে গোটা দশেক দোকান সারা সপ্তাহ খোলা থাকে। সপ্তাহে একদিন হাট সেদিনেই বাজারে লোক সমাবেশ হয়। সন্ধ্যা লাগার আগেই বাজার বন্দ হলে যে যার বাড়ী ঘরে ফিরে যায়।

সৎ মায়ের সংসারে অবহেলাই মানুষ হওয়া মাহিম কোন কুল কিনারা না দেখে সব কিছু থেকে পালিয়ে বাচার জন্য এ চাকরীটা নিয়েছিল। কিন্তু এখানে এই জন মানব শূন্য পরিবেশে বোধহয় চাকরী করা সম্ভব হবে না, সে কথা ভেবে সেই প্রথম দিন থেকেই কি ভাবে বদলী হয়ে অন্যত্র যাওয়া যায় সে চিন্তায় বিভোর থাকে তরুন স্টেশান মাস্টার মাহিম।
এখানে তেমন কোন কাজ নেই বলেই চলে। সকালে আর বিকালে দুটো লোকাল ট্রেন এখানে থামে। আর দিনে দুটো করে আপ ডাউন মেইল ট্রেনের ক্লিয়ারেন্স দেয়া এ স্টেশানের কাজ।

নিজের জন্য রাইস কুকারে ভাত চড়িয়ে দিয়ে ডিম আর আলু ভাজি বা ভর্তা করে তা খেয়ে দিন কাটিয়ে দেয় কোনরকমে।
টিকিট ম্যানেজার বেশ পুরনো কর্মচারী, অনেক বছর ধরে এখানে চাকরী করে। সে এ অঞ্চলেরই মানুষ, স্ত্রী আর ওদের দশ বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে পিছনে কোয়াটারে থাকে। এ্যাংলিয়ানা ওর নাম। সেই কথা দিয়েছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রান্না আর কাপড় চোপড় ধোয়ার জন্য একটা লোক ঠিক করে দেবে।
এ্যাংলিয়ানার স্ত্রী প্রায় প্রতি রাতেই কিছু না কিছু রান্না করে পাঠাই। লজ্জা লাগে মাহিমের, প্রথম প্রথম আপত্তিও করেছিল, কিন্তু অগত্যা কি করা।
প্রথম লোকাল আপ ট্রেনটা আসে সকাল নয়টার দিকে। আবার বিকাল চারটার দিকে ডাউন ট্রেনটা ছেড়ে যায়।
সকাল আটটার দিকে সবাই অফিসে চলে আসে। মোটামুটি গোটা বিশেক মানুষ রেগুলার যাতায়াত করে এ স্টেশান দিয়ে।
সকাল আর বিকেলে লোকাল ট্রেনের সময়টাতে মাহিম একটা চেয়ার পেতে অফিসের সামনে বারান্দাই বসে। ভালই লাগে, এখানে বলতে গেলে একই যাত্রীরা উঠা নামা করে। তাই মাস খানেকের মধ্যেই প্রায় সবার মুখ চেনা হয়ে গেছে। যাত্রীরা উঠা নামার সময় মাহিমকে হাত উঠিয়ে সালাম দেয়।
বেশ ভালই লাগে মাহিমের।
সব মুখ চেনা যাত্রীদের মধ্যে একজন চব্বিশ পচিশ বছরের মহিলা যাত্রীকে মাহিম বেশ আগ্রহ সহকারে খেয়াল করে। অন্যান্যরা হাত উঁচিয়ে বা হাত জড় করে সালাম বিনিময় করলেও ওই তরুণী যাত্রীটি মিষ্টি করে মুচকি হেসে কুশল বিনিময় করে।
এ্যাংলিয়ানার কাছে শুনেছে বাজারের সাথে লাগোয়া একটা সরকারী প্রাইমারী স্কুল আছে, যেখানে ওর ছেলেটা পড়ে, ওই তরুণী সেই প্রাইমারী স্কুলের ইংরেজির মাস্টার দিদিমণি।
ইংরেজির মাস্টারকে বেশ ভালই লাগে মাহিমের। প্রতিদিন সকালে আসার সময় আর বিকেলে যাওয়ার সময় ওর মিষ্টি হেসে ভাব বিনিময় করার মুহূর্তটা দেখার জন্য কেন জানি মাহিমের মনটা চঞ্চল হয়ে থাকে।
সকাল নয়টার দিকে ওর হাসিটা দেখার পর মাহিমের মন থেকে একাকীত্ব ভাবটা যেন উবে যায়। বিকেল অব্দি মনে হতে থাকে সামনে না থাকলেও সেতো ধারে কাছেই আছে। আবার বিকেল বেলা ইংরেজির মাস্টার দিদিমণি মিষ্টি হাসিটা দিয়ে যখন ট্রেনে ওঠে তখন মাহিমের মনটা আবার শূন্যতায় ভরে যায়। সারা রাত ধরে প্রতিক্ষা করতে থাকে পরদিন নয়টা বাজা অবধি।

এ ভাবেই বেশ দিন কেটে যাচ্ছিলো মাহিমের। কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দুটো দিন ওর খুব লম্বা মনে হতে লাগলো। স্কুল দুদিন বন্দ থাকে তাই প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার দিদিমণি ওই দুদিন আসে না। মাহিম মনে মনে হাফিয়ে ওঠে কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারে না।

এ সপ্তাহের শুরু থেকেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। সারা দিন রাত কেবল বৃষ্টি, পাহাড়ী ঢলে নিচু জায়গা গুলো পানিতে ডুবে যেতে লাগলো।
স্টেশানটা একটা ছোট ভ্যালিতে অবস্থিত। পাহাড়ের পানি নেমে মাঠ ঘাট সব ডুবে যেতে লাগলো। পানিতে ডুবে বাজারটা বন্দ হয়ে গেল।
স্টেশান আর তার পিছনে অবস্থিত স্টেশান মাস্টারের বাড়ী তার পর বিশ ফুটের মত গ্যাপ দিয়ে তিনটে লাগোয়া উঁচু ভিতের উপর নির্মিত কোয়াটার গুলোর মেঝে নাক পর্যন্ত ডুবে দাঁড়িয়ে রইল।
প্রবল বর্ষণে মাইল পাচেক দূরে রেল লাইন ডুবে একটা কালভার্ট ভেঙ্গে পড়ে রেল চলাচল বন্দ হয়ে গেল।
জীবন যেন থেমে গেল এখানে। স্কুলও সাময়িক বন্দ ঘোষণা করা হল।

কালভার্ট মেরামত করে রেল চালু না হওয়া পর্যন্ত মাহিমের কোন কাজ নেই। ছাতা মাথায় হাটু পানি ভেঙ্গে অভ্যাস বসত সকালেই স্টেশানে আসে আবার সারাদিন স্টেশানে বসে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যাই বাসায় ফিরে যায়।
বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর দুদিন ট্রেন চলেছিল। তখন থেকেই বৃষ্টির জন্য মাহিম সকালে স্টেশানের খোলা বারান্দাই বসতে পারতো না। ট্রেন আসলে ভিতরে বসেই জানালা দিয়ে খেয়াল রাখতো। সে দুদিন প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার দিদিমণি যাতায়াত করেছে কিনা সেটা সঠিক ভাবে খেয়াল করতে পারিনি মাহিম। আর এ ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করতেও পারেনি।
তারপর তৃতীয় দিন থেকে ট্রেন চলাচল বন্দ হয়ে গেল।

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দিন গুলো কাটছিল মাহিমের।
সেদিন বৃষ্টি আরো ধরে আসলো। মনে হল তাদের সরকারী কোয়াটারের মেঝেতেও না জানি পানি উঠে যায়। কয়েক দিন ধরেই কারেন্ট নেই সন্ধ্যার পর মোম বাতি জ্বালিয়ে কাজ চালাতে হয়।
চারদিক কোন আলো না থাকায় সন্ধ্যার পর পরই রাত গভীর হয়ে যায়।
সেদিন সন্ধ্যা একটু গড়িয়ে গেলেই মাহিম তার বাসার সামনের বারান্দাই একটা চেয়ার পেতে বসলো। অন্ধকারে সামনে স্টেশান ঘরটা আর পাশে অন্যান্য কোয়াটার গুলোর কেবল আকারটা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।
কিছুক্ষণ পর এ্যাংলিয়ানার চিৎকার করে ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে সেদিকে তাকাল মাহিম। বুঝল এ্যাংলিয়ানার গলা কিন্তু পাশের বাসায় ওদের বারান্দাই কিছুই দেখতে পেল না।
কিছুক্ষণ পর কাপড় উপরে উঠিয়ে ছাতা মাথায় এ্যাংলিয়ানা আসলো। বারান্দার নিচে হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল – স্যার কিছু লাগবে।
মাহিম না বলে জবাব দিলে ঘরে পর্যাপ্ত মোমবাতি আছে কিনা নিশ্চিত করল।
মাহিম ওকে উপরে উঠে আসতে বলাতে এ্যাংলিয়ানা -ঠিক আছে এ নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না বলে মাহিমকে আশ্বস্ত করল।
-স্যার, আপনি একাকি আছেন, রাতে কোন দরকার হলে আমাকে চিৎকার করে ডাক দিলেই আমি চলে আসবো বলে এ্যাংলিয়ানা মাহিমকে আশ্বস্ত করল।
যাওয়ার সময় অনেকটা স্বগত স্বরে বলল –আমাকে বোধহয় রাতে জেগেই থাকতে হবে স্যার।
ওর কথা ঠিক বুঝল না মাহিম। কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়েই এ্যাংলিয়ানা অন্ধকারের মধ্যে ওর ঘরের দিকে চলে গেল।

মাহিম নিজের মধ্যে ডুবে গেল।
কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিল সেটা ও নিজেও জানে না। একটা মেয়েলি কন্ঠে সম্বিত ফিরে সামনে তাকালো মাহিম। নিকষ কালো অন্ধকার, রাত কত তা আঁচ করা অসম্ভব।
-কে! মাহিম কিছুটা আৎকে উঠলো যেন।
-আমি স্কুলের ইংরেজী মাস্টার। গত তিন দিন ধরে আটকে আছি এ্যাংলিয়ানা দাদার বাসায়। আপনার সাথে তো কখনো কথাই হল না, তাই ভাবলাম একটু আলাপ করে যায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় মাহিম হতবাক হয়ে অন্ধকারে হাটু পানিতে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলের ইংরেজী মাস্টার দিদিমণিকে কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না।
যার কথা সারা দিন রাত মনের গভীরে ভাবে, যাকে একটু দেখার জন্য মনটা সব সময় আনচান করে সেই মানুষটা গত তিনদিন ধরে ওর এত কাছাকাছি অবস্থান করলেও একটি বারের জন্যও জানতে পারলো না!
-এ্যাংলিয়ানাও একটি বারের জন্যও সে কথাটা বলল না! এ্যাংলিয়ানা সে কথা মাহিমকে কেনই বা বলবে? ইংরেজী মাস্টার দিদিমণি বিপদে পড়ে তিন দিন ধরে ওর বাড়ীতে আটকে আছে সে কথা মাহিমকে সে কেন বলবে? ভাবছিল মাহিম।
-আপনি উপরে উঠে আসুন না!
অনেক সাহস সঞ্চার করে কথাটা বলল মাহিম। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে বারান্দার ধারে এসে দেখল কেউ নেই সেখানে।
সব কিছু মনের ভুল বলে মনে হতে লাগলো মাহিমের।
সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারল না মাহিম।
খুব সকালে স্টেশানে গেল মাহিম।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। আকাশও পরিষ্কার হয়ে পাতলা মেঘের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সূর্যও উঁকি ঝুঁকি মারছে।
মাহিম নির্জন স্টেশানের বারান্দাই গিয়ে বসলো। মনটা কেমন যেন অশান্তিতে ভরে আছে।
এ্যাংলিয়ানা আসলো। ওর চোখে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ সুস্পষ্ট।
মাহিমের হৃদয়টা ছ্যাৎ করে উঠলো।
-স্যার, ভোরের দিকে মাস্টার দিদিমণি মারা গিয়েছে। গত তিন দিন ভীষণ জ্বর নিয়ে আমাদের বাসায় ছিল। বোধহয় সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া। দশটার দিকে স্কুলের মাঠে ওর শেষকৃত্য হবে। সবাই আসবে। আপনি কি যাবেন?
কিছুই বলল না মাহিম। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল মাহিমের বুক খালি করে।
নিজ রুমে ঢুকে ওয়াস রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা বন্দ করে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল মাহিম। বোবা কান্নায় বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল।

দূরে দাঁড়িয়ে জলন্ত আগুনে মাস্টার দিদিমণির দেহটা ভস্ম হয়ে যেতে দেখল।
অজানা অচেনা একটা মানুষের জন্য যদি বোবা কান্নায় বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয় তবে কি সেটাকে ভালবাসা বলে!
-সে রাতে মাস্টার দিদিমণি ওই শরীর নিয়ে কেন এসেছিল আমার খোঁজ নিতে! কিসের টানে এসেছিল সে!
-আসলেই কি সে এসেছিল না ওটা মাহিমের মনের ভ্রম ছিল!
এ সব কিছুর উত্তর মাহিম হয়তো কোনদিন খুঁজে বের করতে পারবে না, আর কাউকে সেকথা জিজ্ঞেসও করতে পারবে না। কারণ নামহীন ভালবাসার কথা কাউকে বলা যায় না। বলতে মানা।