জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -৮।

আপডেট: ০২ Jul ২০২৩, ১০:২৪

জীবনের অন্যপিঠ -৮ 

 

-চলুন।
অমরের আহবানে নাস্তার টেবিলের দিকে পা বাড়ালো ওরা।
টেবিল হেডে অমর আর দুপাশে লাবনী ও অনিরূদ্ধ বসল।
-মিষ্টার চৌধুরী, হাসপাতাল আর চিকিৎসা নিয়ে আপনার যে পরিকল্পনার কথা শুনেছি আর আজ এলাকাটা যতদুর দেখেছি তাতে আমার বিশ্বাস আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আদর্শ একটা জায়গা এটা। আপনার যে বড় পরিকল্পনা সেটা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে। ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে এ্যডহক ভিত্তিতে কোন কিছুই নির্মান করা ঠিক হবে না। সব নির্মান মাষ্টার প্লান অনুযায়ীই হতে হবে।
ডাক্তার লাবনীর দূরদর্শিতাপূর্ণ উপদেশ মুগ্ধ করলো অমরকে।
-এটা বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্বই অনিরূদ্ধর উপর। ওর উপর আমার আস্থা অটুট। আর আপনার সহযোগীতা ওর বিশেষ সহায়ক হবে।
-অমর চৌধুরী হাসপাতাল ছাড়াও আরো অনেকগুলো প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। তার সবগুলো প্রজেক্টই খুবই চিন্তাপ্রসুত।
অনিরূদ্ধর মন্তব্যে লাবনী তাকালো অমরের দিকে।
-টেকনিক্যাল ব্যপারে আমার জ্ঞান সীমিত। আমি শুধু আমার কিছু চিন্তা চেতনা বাস্তবায়ন করতে চায়। যার ভার পুরোপুরিই আপনাদের উপর ন্যস্ত। আপনাদের পরামর্শ আর সহযোগীতায় আমার প্রধান সহায়ক।
-মিষ্টার চৌধুরী, স্বপ্ন দেখাটায় কিন্তু সব কিছুর মূল। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পেশাজীবিদের অভাব হয় না। অভাব কেবল চিন্তা চেতনার, স্বপ্নের। বাস্তবে মাথা খাটালেই কাজ হয়ে যায় কিন্তু গঠনমূলক চিন্তা চেতনার জন্য মেধার সাথে মন লাগে, অন্তর লাগে। এই সমন্বয় সত্যিই বিরল।
অমরের কথার উত্তরে লাবনী বলল।
-অনিরূদ্ধ ওর পেশার বাইরে, এই হাসপাতালের মূল পরিকল্পনা তৈরী করা এবং বিভিন্ন পর্বে তা বাস্তবায়নের জন্য যেভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছে তার জন্য আমরা সবাই ওর কাছে ঋণী। সত্য কথা বলতে কি, ওর মত একজন সম্ভাবনাময় তরূনকে এভাবে এখানে পাব তা ছিল আমার কল্পনারও অতীত।
অমরের করা সরাসরি প্রশংসাই অনিরূদ্ধ আবারো কিছুটা জড়ষড় হয়ে বসলো।
-না অনিরূদ্ধ, আপনাকে শোনানোর জন্য কথাটা বলিনি আমি। আপনাকে অপ্রস্তুত করে দেয়ার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। ডাঃ লাবনীর আন্তরিকতার প্রসঙ্গেই কথাটা উঠে আসলো।
-সত্যি বলতে কি, কাজের তদারকির সুবিধার্থে কষ্ট স্বীকার করেও অনিরূদ্ধ গত কিছুদিন থেকে এখানেই থাকে।
-ও নিয়ে চিন্তা করবেন না মিঃ চৌধুরী, এখানে থাকাতে কষ্টতো দূরের কথা আমার মনে হয় নিজ বাড়ীতেই আছি।
ওর জবাবে মুগ্ধ হয়ে ডাঃ লাবনী তাকালো টেবিলের উল্টো দিকে বসা অনিরূদ্ধর দিকে। এ দুজন প্রায় সমবয়সী মানুষের মধ্যে এত পরিপক্ক একটা বোঝাপড়া এবং পরস্পরের জন্য সন্মানবোধ ওকে মুগ্ধ করলো।

এখানে আসার আগে অনেক ভেবেছে লাবনী। রাজধানী শহর থেকে এত দূরে কি করে থাকবে ও?
রাজধানী শহরে অবস্থানটা ওর কাছে পুরোপুরি অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। শহরটা না ছাড়লে ওর হয়তো অস্বস্তিতে দম বন্দ হয়ে যেত।
দেশের এ অঞ্চলে ওর কখনো আসা হয়নি। ওর চাচা এই শহরেই একজন সরকারী কর্মকর্তা। তার কাছ থেকেই চৌধুরী পরিবার সন্মন্ধে গুনেছে বিশেষ করে বর্তমান চৌধুরী অর্থাৎ অমর চোধুরীর কথা।
তারপর সব ভেবে চিন্তে মফঃস্বল শহর থেকে প্রায় পাচ কিলোমিটার দূরে এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে গতকাল এসেছে ওর চাচার ওখানে।
অন্যমনষ্ক হয়ে যাওয়া ডঃ লাবনীর দিকে তাকিয়ে দেখলো অমর।
-আপনি ঘুরে দেখুন প্রজেক্টটা। জানিনা পছন্দ হবে কিনা। সবইতো এলোমেলো, গুছিয়ে নিতে হবে। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারি আপনাকে।
লাবনী আর অনিরূদ্ধ দুজনেই তাকালো ওর দিকে।
-রোগীর কোন ঘাটতি হবে না।
লাবনী কিছু একটা বোধহয় বলতে যচ্ছিলো।
ওকে থামিয়ে দিয়ে অমর বললো -তবে সমস্যা হবে ওদের ভাষা নিয়ে।
-কেন, ওরা বাঙলা বলে না?
-বলে, তবে আপনার মত শহুরে বাংলা নয়। তায় তাদের বলা বাংলা বঙ্গানুবাদ করে আপনাকে নতুন করে শিখতে হবে।
মৃদু হাসলো সবাই ওরা।
-প্রথম প্রথম আমারও অসুবিধা হতো, তবে এখন ঠিক হয়ে গেছে।
হাসি মুখে বলল অনিরুদ্ধ।
লাবনীর ভারী ভালো লাগলো পুরোপুরি শহুরে এবং পশ্চিমা ধাচের আচার আচরণ সম্পন্ন অমর চৌধুরী আর অনিরূদ্ধর মনোভাব দেখে।
-যেমন ধরূন, অসুদ পত্র কি ভাবে খেতে হবে তা বুঝিয়ে বলার পর ওরা বলে-ঠিকাছ। ওটার অর্থ আমি বুঝতাম না। আবার কিছু মনে করে কিনা তায় জিজ্ঞেসও করতাম না। পরে রামদয়ালের সাথে কথা বলে বুঝলাম, ঠিকাছ মানে ঠিক আছে।
সবাই হালকা মেজাজে হাসলো একটু।

এত ব্যস্ততার মধ্যে রামদয়ালের সাথে আর দেখা হয়নি অমরের। ভাবলো ওকে ডাকবে একবার।
নাস্তা শেষ করে অমর লাবনীকে উদ্দেশ্য করে বললো –চলুন, একটু ঘুরে দেখবেন আপনার কেমন লাগে?
ওরা সবাই হাসপাতালের দিকে পা বাড়ালো।
পুরনো ডাক্তারখানার সামনে কয়েকজন রোগী ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করছে। তারই অদূরে নির্মান কাজ চলছে।
ওদিকেই গেল ওরা হাটতে হাটতে।
-আপাততঃ পুরূষ আর মহিলা রূগি দেখার জন্য আলাদা আলাদা দুটো কমপ্লেক্স তৈরী করা হচ্ছে। প্রতিটা কমপ্লেক্সে দশটা করে বেড থাকবে।
অনিরূদ্ধ সব বুঝিয়ে বললো আর ওরই নির্দেশিত পথে ওরা নির্মান কাজ দেখতে লাগলো সকলে।
হটাৎ করে অমরের দৃষ্টি পড়লো রামদয়ালের আয়ুর্বেদ বাগানের এক কোনায় ছোট্ট বসার জায়গাটায় একটা ঈজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা ওর মা নীলিমা চৌধুরীর দিকে।
স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি বাড়ী থেকে কোথাও বের হন না। আজ তাকে বেরূতে দেখে ভালো লাগলো অমরের।
ওদেরকে নিয়ে ওদিকেই পা বাড়ালো অমর।

লীলিমা চৌধুরীর বয়স ষাটের কোটা ছাড়িয়ে সত্তর ছুঁই ছুঁই। স্বাস্থ্য সচেতন আর কাপড় চোপড়ে চিরকালই পরিপাটি তিনি। বড় সরকারী চাকুরে ছিলেন। সারাটা জীবনই কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন।
প্রথম দিকের কয়েকটা বছর বাদ দিলে চাকরীর বাকি সময়টা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পোষ্টিয়ে পোষ্টিয়ে কাটিয়েছেন। অবসর নেয়ার পর থেকে রাজধানী শহরে চৌধুরী লজে থাকতেন।
সরকারী চাকুরীজীবী হিসাবে বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই বাইরে থাকতে থাকতে স্বামীর সাথে তেমন বোঝা পড়া গড়ে ওঠেনি কখনো। তায় স্বামীর সাথে সম্পর্কটা বলতে গেলে চিরকালই নিচক সামাজিকতায় ছিল, প্রকৃত অর্থে উষ্ণ নয়।
জীবনের বেশী সময়টা নীলিমা চৌধুরী বিভিন্ন কাজে নিজেকে ডুবিয়ে নিজের একটা আলাদা জগত গড়ে তুলেছিলেন।
কিন্তু স্বামীর হটাৎ মৃত্যু তার সবকিছুই যেন এলোমেলো করে দিল। স্বামী থাকতে নিজের মত করে নিজের জগৎ নিয়েই থাকতেন নীলিমা। স্বামীর জন্য বিশেষ কোন জায়গা ছেড়ে দিতে হয়নি কখনো।
কিন্তু হটাৎ করেই আমির চৌধুরী মারা যাওয়ার পর যেন তিনি টের পেলেন তার জীবন থেকে বড় একটা কিছু চলে গেল।
বাতাসের মধ্যে থাকতে থাকতে সবাই বাতাসের অস্তিত্ব ভুলে যায়। বাতাসের কমতি হলে যখন দম বন্দ হওয়ার মত হয় কেবল তখনই টের পাওয়া যায় সেটার অস্তিত্ব। স্বামীর মৃত্যুটা নীলিমা চৌধুরীর কাছে ঠিক তেমনি দম বন্দ হয়ে যাওয়া একটা অনুভূতির সৃষ্টি করেছে।
চৌধুরী এষ্টেটে আসা অব্দি অমর অমনি অবস্থায় দেখছে মাকে। মায়ের সাথে অমর বলতে গেলে কোনদিনই খোলামেলা ছিল না আর এতদিন পর তেমন ভাবে ঠিক খোলামেলা হতে পারে না।

ওদেরকে দেখে নীলিমা চৌধুরী একটু সোজা হয়ে বসলেন।
-মা, ইনি ডাঃ লাবনী, আজ সকালে এসেছেন। আর অনিরূদ্ধর কথাতো তোমাকে বলেছি।
স্মিত হাসলেন নীলিমা চৌধুরী।
এই প্রথম মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখে ভারী ভালো লাগলো অমরের।
ওরা সালাম দিতেই ওদেরকে বসতে বললেন নীলিমা চৌধুরী।
পাশে আর একটা মাত্র চেয়ার।
অমরকে আরো দুটো চেয়ার আনতে বলায় অমর কি একটা ভেবে নিয়ে তারপর বললো -চেয়ারের কথা বলছি মা, তুমি ডাঃ লাবনীর সাথে কথা বলো, আমি অনিরূদ্ধকে নিয়ে ততোক্ষনে একটু ঘুরে দেখে আসছি।
নীলিমা চৌধুরীর প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে লাবনীকে। ওর গাম্ভীর্য্য, ওর সৌন্দর্য্যে সবকিছুর মধ্যে একটা যেন ব্যতিক্রম আছে।
নীলিমা চৌধুরীর আন্তরিকতা মুগ্ধ করলো লাবনীকেও।
দুজনের মধ্যে নীরবে একটা বোঝাপড়া গড়ে উঠলো অল্পতেই।
দুজনেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলো। অনেক কথা বললো ওরা। হাসপাতাল নিয়ে, অমরের পরিকল্পনা নিয়ে ইত্যাদি। এরই ফাকে লাবনী ওর নিজ সম্পর্কেও অনেক কথা বললো।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর ফিরলো অমর।
পাশের চেয়ারটাতে বসতে বসতে জানালো যে বেশ কিছু রোগী আছে তায় অনিরূদ্ধ আসতে পারলো না। ও রোগী দেখতে শুরূ করে দিয়েছে।
-অনিরূদ্ধতো তোর ওদিকটাতে থাকছে। লাবনী আমার পাশের ঘরেই থাকবে। ওর ছেলেকে নিয়ে দু এক দিনের মধ্যেই চলে আসবে এখানে।
অমর তাকালো লাবনীর মুখের দিকে।
লাবনী তাকিয়ে গাছের ডালের ফাক দিয়ে উকি দেয়া আকাশের দিকে। মৃদু বাতাস দুএকটা চুল এলোমেলো করছে। গাছের ফাক দিয়ে উকি ঝুকি দিয়ে সূর্যের কিরণ ওর চোখ মুখ ছুয়ে দেয়ার জন্য যেন লুকোচুরী খেলছে।