জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১৪।

আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪:০২

অম্বরাবনী-১৪ 

 

কাজে ফিরে একটু সময় না যেতেই মনটা আবার অতৃপ্তিতে ভরে উঠলো অবনীর। কাজের পরিবেশে অম্বল নিশ্চুপ থাকে কোন কথা বলে না। মন চায়লো আবার ফিরে যেতে রাঈনের গর্জনের কাছে। জলপ্রপাতের গর্জনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি যে কথা বলে তা অম্বরেরই কথা যা শুনতে ব্যাকুল থাকে অবনী।
কিন্তু অংকের নিয়মের দৌরাত্ব আর ছুটির স্বল্পতা বিবেচনায় মোজামবিক থেকে অদুরে জিম্বাবুয়ে জাম্বিয়া সিমান্তে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতে গেল অবনী।
আহ আবার প্রকৃতির একদম কাছাকাছি। ঐ একই রূপ রস গর্জন। এখানেও প্রকৃতির সাথে কথা বলা যায়, প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেখা যায়, গন্ধ নেয়া যায়। প্রকৃতির অভায়ারন্যে অবনী হারিয়ে গেল নিজের মাঝে।
শরীর প্রাণ দুইই জুড়িয়ে গেল। নিজেকে খুঁজে পেয়ে আবার নিজের ভিতর ডুব দিল অবনী।
মনে হলো জল পড়ার গর্জন আর একটু ভাটিতে কিছুটা শান্ত হয়ে গন্তব্যে ছুটে যাওয়ার দৃশ্য অম্বরকে নাড়া দিয়েছে। অবনী আর অম্বর দুজনেই তৃপ্ত।
জলপ্রপাতের গর্জনের স্বরূপ উদ্ধারে কান পেতে শুনতে বুঝতে চায়লো সে গর্জনের সুর। একবার মনে হলো অবনী তার এই পথচলা এত ব্যস্ততা সব কিছু নিয়ে আছড়ে পড়ে ভাটিতে মিশিয়ে দিক নিজেকে। শান্তি যেন উজানে নয় ভাটিতে।
কি করবে এখন কিছুই ঠিক করতে পারছিল না অবনী। জীবনের এত অর্জন এতকিছু সব যেন মোহের মত মনে লাগলো। এর জালে জড়িয়েই দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য সবাই কেবল ছুটছে। ছুটাছুটি করার নামই যেন জীবন।
ব্রিটিশ পরিব্রাজক লিভিংষ্টোন এই জলপ্রপাতটাকে আবিস্কার করে তিনি তার দেশের রানীর নামানুসারে এর নামকরণ করেছেন ‘ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত’। তাঁর কীর্তিকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য একটা বড় বেদীর উপর মিষ্টার লিভিংষ্টোনের একটা মর্মর মূর্তি বানানো হয়েছে।
কালো পাথর কেটে মুর্তিটা তৈরী। এ যেন অক্ষয় কালজয়ী এক সৌন্দর্য্য। কোন কিছুই ওর উজ্জলতাকে নষ্ট করতে পারে না। ওর আবিষ্কারের পাশেই শীর উচু করে দাড়িয়ে এই অবিনশ্বর মহাপ্রান।
শোনা যায় মিষ্টার লিভিংষ্টোন এটা আবিষ্কার করার পূর্বে এখানে ভয়ে কেউ আসতো না। দূর থেকে জল পড়ার গর্জন শুনে আর জলের চ্ছটা ধোয়ার মত উপরে উঠতে দেখে এখানকার মানুষেরা ভাবতো সেখানে কোন বন দেবতার বাস, তায় দূর থেকেই প্রনাম করে ক্ষান্ত থাকতো।
এই অক্ষয় অবিনশ্বর কালো পাথরের মহাপ্রানকে প্রনাম করতে খুব ইচ্ছা হলো অবনীর। কি সৌভাগ্যবান এই ইংরেজ সন্তান। নিজের বলতে যা বুঝায় তার সবকিছু ত্যাগ করে অপরের জন্য কি মহান বলিদান।
মিষ্টার লিভিংষ্টোনের মর্মর মুর্তির সোপানে বসলো একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসলো ওর দিকে তাকিয়ে। সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এই গভীর জংগলে কি এক অপরূপ সৌন্দর্যের আবিস্কারক এই মহাপ্রান।
তার এই আবিস্কার এ দেশের মানুষের জন্য চিরস্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা করা ছাড়াও দেশটাকে বিশ্ব পরিচিতির আসনে বসিয়েছে।
প্রতিদিন দেশ বিদেশের হাজার হাজার মানুষ এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে মন প্রাণ জুড়াচ্ছে।
এই মুহুর্তে মর্মর মুর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মহাপুরুষ তাঁর কৃতিত্ব উপভোগ করছে কিনা তা বোঝা অসম্ভব, তবে এই বিলেত সন্তানের কাছে এদেশের এবং দুনিয়ার সব মানুষ যার পর নেই ঋণি তা বুঝে অবনী ভক্তিতে শত কোটি সালাম জানালো ওর প্রয়াত আত্মাকে।
ওর মুর্তিটার দিকে ভক্তিভরা দুনয়নে তাকিয়ে ছিল অবনী। এমন সময় সেখানে ওদেশের একজন উঠতি বয়সি যুবককে যেতে দেখে ওর সাথে গায়ে পড়ে একটু আলাপ করার জন্য মন চায়লো তার। সে ভাবল এই আফ্রিকার গহীন জংগলে এই নির্জনতায় বসে সাত সমুদ্র তের নদীর পার হয়ে আসা এই মানুষটির প্রতি বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে অবনী, এক ভিনদেশী আর ওই ছেলেটির মত একজন স্বদেশী মিলে সকলের ঋনের কথাটা স্মরন করে মন্টা তৃপ্তিতে ভরে নেবে।
কৃষ্ণদেহী ছেলেটি হাসিমুখে অবনীর আহবানে সাড়া দিয়ে দাড়ালো। ওর দেশে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ জানালো। ওর কথাবার্তাই বোঝা গেল ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নব্যযুগের জিম্বাবুয়েনদের একজন।
ছেলেটি ওর অতীত, ইংরেজদের নির্যাতন, কালোদের উপর সাদাদের প্রভুত্ব ইত্যাদি ব্যপারে সচেতন।
ইংরেজদের দেয়া ভাষাকে দেশের ভাষা বানিয়ে সে ভাষাতেই গড়গড়িয়ে কথা বলছে। ওদের মত পোষাক পরিচ্ছদ আচার আচরন সবই। ভালোই লাগলো আর বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল অবনী।
তারপর ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের প্রসঙ্গ উঠিয়ে এর আবিস্কারক ঐ মুর্তিটির ব্যপারে কথা উঠাতেই ও যেন দপ করে জ্বলে উঠে অগ্নিসর্মা হয়ে উঠলো। মনে হলো কিছুক্ষন আগের আধুনিক জগতের কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটি আর নেই। ও যেন হয়ে উঠলো সেই ছোটকালে শোনা মানুষখেকো গাছ ভর্তি আফ্রিকার জংগলে বসবাস করা মানুষদের একজন।
-আমরা সবাই, এই কালো চামড়ার মানুষ, এই জলপ্রপাত সবইতো এখানে ছিল। সেটা আবিস্কার করার আবার কি হলো। আমরা এখানে আছি এটা যদি কেউ না জানে তাহলেতো এর জন্য কি আমরা দায়ী?
সদ্য পরিচিত কৃষ্ণকায় যুবকটি অগ্নিমুর্ত্তি হয়ে মর্মর মুর্তিটার দিকে তাকালো।
-নাম দিয়েছে ভিক্টোরিয়া!
ওর কণ্ট দিয়ে ঘৃনা ঠিকরিয়ে পড়লো।
-আপনিই বলুন, ইন্ডিয়ান ওশানের নাম যদি পর্তুগিজ বা ওলোন্দাজ ওশান দেয়া হয় কারণ ওরাইতো প্রথমে ঐ সাগরে জাহাজ চালিয়েছে, তাহলে আপনার কেমন লাগবে?
-ভিক্টোরিয়া ফলস বলে কোন জলপ্রপাত ইউরোপ বা ইংল্যান্ডে আছে কিনা জানিনা কিন্তু ঐ নামে কোন জলপ্রপাত আমাদের দেশে নেই।
অগ্নিমুর্ত্তি কৃষ্ণকায় যুবকটি ঐ জলপ্রবাতকে Mosi-oa-Tunya অর্থাৎ "the smoke that thunders" বলে সন্মোধন করে একটা আত্মতৃপ্তিতে ভরা স্মিত হাসিতে ওর মুখোমন্ডলটা ভরে তুললো। ভারী সুন্দর দেখালো ওকে।
বিধাতা প্রতিটি মানুষের জন্য তাঁর এই বিশাল পৃথিবীর এক একটা এলাকা নির্ধারন করে ঐ এলাকার সাথে সামজ্ঞস্য করে তার শরীর মন, শারীরিক রং, পছন্দ অপছন্দ সব কিছুই নির্ধারন করে দিয়েছে। সব জাতি গোষ্ঠিকে তাদের বাইরের চেহারাটা এমন ভাবে বিধাতা সৃষ্টি করেছে যেন চোখের দেখাতেই তার জন্য নির্ধারিত স্থান সম্পর্কে বোঝা যায়।
সবাই বিধাতার এই দান নিজ নিজ কৃষ্টি আর জন্ম স্থানকে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতে চায়।

অবনী চেয়েছিল ওর নিজের বলতে যা কিছু সব কিছুকে ঢেকে দিয়ে ওর মন মত যুগোপযেগী করে সব কিছু গড়তে। ভাবতো দেশে আর কোন দিনই ফিরে যাবে না ও। জীবনের অর্ধেকটারও বেশী সময় ধরে নিজের পরিবার পরিজন এবং পরিশেষে দেশ ছেড়ে এসে অবনী নিজেকে অন্য এক মানুষে পরিবর্তন করতে ব্যস্ত ছিল। পরিকল্পনাও করেছিল শেষ জীবনটা ইউরোপ বা আমেরিকার কোথাও কাটিয়ে দেবে।
কিন্তু একি হচ্ছে। নিজের আসল চেহারাটা ঢেকে দিয়ে আয়নাতে ও নিজেকে অন্য রূপে দেখতে নিজের চোখ দুটোকে অভ্যস্ত করালেও অন্য সব চোখ গুলোকে সে ভাবে অভ্যস্ত করানো তো সমভব নয়।
অবনীর কথাবার্তা বেশভূষা কোনটায় ওর নিজের দেশের মত নয়। আর জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে উন্নত বিশ্বের মানুষদের সাথে কাজ করতে করতে ওর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, মুল্যবোধ সব কিছুই পাল্টে গিয়েছে। এমনকি স্বপ্নেও অবনী মিশিশিপি বা টেমসকে দেখে, পদ্মা গঙ্গার কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছে।
কিন্তু একি হলো, আফ্রিকায় ঐ কৃষ্ণকায় ছেলেটি ওর সব লালিত বিশ্বাসের মূলে যেন কুঠারাঘাত করল। লিভিংষ্টোনের আত্মাটা ওদের অভিশাপে জর্জরিত হয়ে ঐ কালো পাথরের শক্ত মুর্তির দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার জন্য হাহুতাস করছে বলে এই মুহূর্তে মনে হতে লাগলো অবনীর।
অম্বরের কান্নার সুরটা আবার পরিস্কার হয়ে অবনীর বুকে বিঁধতে লাগলো। জলপ্রপাতের স্যাঁ স্যাঁ গো গো শব্দ অম্বরের কান্না হয়ে অবনীর কানে বাজতে লাগলো। মনে হলো আরো কিছুক্ষন থাকলে সে হয়তো জ্ঞান হারাবে।
তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসলো।